গার্ডসাহেবের বিপদ
আমরা চার বন্ধু মিলে বেড়াতে গেছি বকখালি।
শিয়ালদা সাউথ স্টেশন থেকে নামখানা লোকাল করে নামখানা স্টেশনে পৌঁছলাম যখন বাইরে টিপটিপ করে বৃষ্টি শুরু হয়ে গেছে। নামখানা স্টেশনের গায়ে লাগিয়ে ভ্যানের স্ট্যান্ড। ভ্যানে করে নৌকাঘাটে পৌঁছতে পৌঁছতেই তেড়ে বৃষ্টি এল।
শেষ শ্রাবণে সমুদ্র দেখব বলে এসেছি। সঙ্গে ছাতা ছিল। তাই ছাতা খুলে ঘাট পার হলাম। হাতানিয়া-দোয়ানিয়া ছোট নদী। অনেকটা খাঁড়ির মত। প্রচুর মাছ ধরার ট্রলার দাঁড়িয়ে আছে।
নদী পেরিয়ে আবার বাস। রাস্তা বেশ ভাল। তবে সরু। মিনিট পঁয়তাল্লিশের বাসযাত্রার পর বকখালি। রাস্তার দুপাশের পরিবেশ খুব মনোরম। নতুন রোওয়া ধানচারা বৃষ্টির জলে উচ্ছ্বসিত। অনেক দূরে দূরে চাষীদের বাড়ি। একা বৃষ্টিতে ভিজছে।
বৃষ্টিতে দুঃখ পাব না আনন্দ পাব বুঝতে পারছি না। এসেছি বৃষ্টিতে সমুদ্র দেখব বলে। আবার বেশি বৃষ্টিতে ঘোরাও যাবে না। কোথাও না যাই ফ্রেজারগঞ্জে মাছের আড়ত দেখতে তো যেতেই হবে। হাতে মোটে দুদিন সময়। বৃষ্টি থামবে তো?
বাস এসে দাঁড়াল বকখালিতে। অনেক সুন্দর সুন্দর হোটেল। কিন্তু খুঁজতে গেলে ভিজতে হবে। আমরা তাড়াতাড়ি বাস থেকে নেমে পাশের বলাকা হোটেলে উঠলাম। বর্ষায় অফ সিজন। আমাদের ঘর পেতে কোন অসুবিধা হল না। দোতলার ঘর। ডবল বেডের দুটো খাট। জানালা দিয়ে সুন্দর বর্ষার প্রকৃতি দেখা যাচ্ছে। তবে বকখালিতে সমুদ্র অনেক দূরে। হোটেলগুলো থেকে ঝাউগাছও দেখা যায় না। সমুদ্র দূরস্থান। যাই হোক এবার টানা বৃষ্টিটা দেখে মন খারাপ করতে শুরু করল।
সবাই খুব ক্লান্ত ছিলাম। অনেক সকালে বাড়ি থেকে বের হয়েছি। পেটে ছুঁচোয় ডন দিচ্ছে। একে-একে স্নান করে হোটেলের ডাইনিং রুমে খেতে গেলাম। খেয়েদেয়ে বিছানায় শুয়ে কখন যে ঘুমিয়ে পড়েছি হুঁশ নেই।
ঘুম ভাঙতে দেখি সারাটা ঘর সিগেরেটের ধোঁয়ায় ভরা। আমাদের মধ্যে বিভাস আর প্রবীর চেন স্মোকার। বুঝলাম ঘুম থেকে উঠেই ধরিয়েছে।
সিগারেটটা একটু বাইরে গিয়ে খেলে হত না?
অতনু আমাদের মধ্যে সবচেয়ে স্বাস্থ্যসচেতন ও সাত্বিক।
দাঁড়া তো বেশি জ্যাঠামো করিস না। বিভাস ধমকে ওঠে।
বৃষ্টি কমেছে রে?
আমার তখনও ঘুম জড়ানো গলা।
নাঃ বৃষ্টি কমার তো কোন নামগন্ধই নেই। বরং জোর আরও বেড়েছে।
অতনুর গলায় হতাশা ধরা পড়ল।
ঘড়ির দিকে তাকিয়ে দেখলাম প্রায় সাতটা বাজে। বাইরে জেনারেটরের আওয়াজ পেলাম। মানে লোডশেডিং। কতক্ষণ চলবে কে জানে? রাস্তাঘাট অন্ধকার। আলো জ্বলছে না। দোকানগুলোতেই শুধু আলো জ্বলছে।
বকখালিতে লোকজন কম আসে। দীঘার বা পুরীর মত গাদাগাদি ভিড় নেই। আর তাই শ্রাবণের অঘোর বর্ষণে লোডশেডিং এ ঘরে বসে থাকা ছাড়া কোন উপায় নেই।
প্রবীর প্রস্তাব দিল ব্রিজ খেলার। সম্মত না হয়ে উপায় নেই। ব্যাগ থেকে তাস বেরোল। আর সাথে সাথে লাইট পাখা অফ। ধ্যাক্ ধ্যাক্ করে জেনারেটর বন্ধ হয়ে গেল। বুঝলাম শেষ আশাটাও গেল।
এখানকার অবস্থাটা আমাদের মফস্বলের থেকেও খারাপ। কখন আলো আসবে কে জানে?
বাইরে বৃষ্টির প্রচন্ড শব্দ কানে আসছে। আর মাঝে মাঝে বিদ্যুতের চমকানিতে আমরা চার বন্ধু একে অপরের মুখ দেখতে পাচ্ছি। ঘরের ভেতর ঘুরঘুট্টি অন্ধকার। বাইরে রাস্তার পাশের চায়ের দোকান থেকে হালকা হ্যাজাকের আলো চোখে এসে পড়ছে।
এই পরিস্থিতিতে যা আসার তাই এল। ফিরে এল মফস্বলের সন্ধ্যা আর অবধারিতভাবে তেনাদের কথা।
আচ্ছা তোর জীবনে অলৌকিক বা ভৌতিক কোন ঘটনা ঘটেছে কখনও?
কেন তা থেকে তুই শারদীয়ার গল্পটা মারবি নাকি?
আমাদের মধ্যে অতনু একটু লেখেটেখে। দুই একটা মাসিক পত্রে তার লেখা টেখা মাঝে মধ্যে বের হয়। বিভাস তাই অতনুকে একটু খোঁচা দিল।
তবে যাই বলিস আজ কিন্তু ভূত ছাড়া আর কিছুই আসছে না।
বেশ তাহলে শুরু করা যাক। প্রবীর তুই কিছু বল।
অনেক ভণিতা করে প্রবীর শুরু করল।
দেখ আমি ভূত-প্রেত বিশ্বাস করি না। আর অলৌকিক কিছু আমার জীবনে এখনো পর্যন্ত ঘটেও নি। তবে ঘটনাটা আমার বাবার মুখে শোনা। কোন জল নেই। যা শুনেছি তাই বলছি।
বাবা তখন স্কটিশে পড়ে। বাবাদের দেশের বাড়ি ছিল উত্তরবঙ্গের গঙ্গারামপুর। রায়গঞ্জের কাছে। বাবা কলকাতায় একা থেকে পড়াশোনা করত। তখন মেসে থাকার খুব চল ছিল। বাবা মেসে না থেকে ডাফ্ হোস্টেলে থাকত।
সেবার বাড়ি থেকে আচার নিয়ে ফিরেছে। ঠাকুমার বানানো আচার। বয়ামটা এনে বাবা টেবিলের ওপর রেখেছে। হঠাৎ লোডশেডিং হয়ে গেল। বাবা বাইরে থেকে পাঁউরুটি কিনে এনেছিল। আচার দিয়ে খাবে বলে। হাতে টাকা পয়সা খুব কম ছিল। সেই ভেবেই আচার আনা। সকাল আর বিকেলে খাবারের খরচ অনেকটা বাঁচে।
কিন্তু হাতে পাঁউরুটি নিয়ে টেবিলের ওপর তাকিয়ে দেখে বয়ামটা উধাও। কাছে গিয়েও দেখে নেই। যেন ভোজবাজির মত কাঁচের বয়ামটা উবে গেছে।
বাবা গ্রামের ছেলে। ভয় ডর বিশেষ নেই। কিন্তু বাবার কপালেও বিন্দু বিন্দু ঘাম জমে উঠল। দরজা বন্ধ। বন্ধুরা যে মজা করে নিয়ে যাবে তারও উপায় নেই। অথচ বয়ামটা তো এইমাত্রও টেবিলের ওপরেই ছিল!
বাবা দরজাটা খুলতে যাবে এমন সময়ই কারেন্ট এল। আর কি আশ্চর্য! আলোতে দেখল বয়ামটা ঠিক টেবিলের উপরই রাখা আছে।
বাবা নিজের চোখকেও যেন বিশ্বাস করতে পারছেন না। ভয়টা আরও পেড়ে বসল। আচারটা খাবার ঠিক সাহস হল না। তক্ষুনি দরজা বন্ধ করে বাবা হোস্টেল সুপারের ঘরে গেল। সুপার লোক ভাল ছিলেন। বাবা ভয় পেয়েছে দেখে সেই রাতে বাবাকে নিজের ঘরে শুতে দিলেন।
সুপার সাহেব বাবাকে বললেন এর আগেও বোর্ডাররা বারবার এমন নানা সমস্যার কথা বলেছে। কেউই এক মাসের বেশি ওই ঘরে থাকতে পারে নি। যা হোক উনি পরের দিন থেকে বাবাকে অন্য ঘরের ব্যবস্থা করে দিলেন। আর পাকাপাকিভাবে ঘরটিতে তালা দিলেন।
সেদিন থেকে আজ অবধি কেউ ওই ঘরে থাকে না। আজও ডাফ্ হোস্টেলের ওই ঘর বন্ধ আছে। ডাফ্ হোস্টেলের ৪৪ নম্বর ঘরের শেষ বোর্ডার হিসেবে বাবার নাম আজও লেখা আছে, আমি নিজে গিয়ে দেখে এসেছি।
গল্পটা শুনে আমরা খুব ভয় পেলাম না ঠিকই তবে বেশ একটা ভুতুরে পরিমন্ডল তৈরি হল।
অতনু কিছু বলবে না জানি। ও ওর স্টক অন্যখানে ক্লিয়ার করে। আর আমি আগেই হাত তুলে দিয়েছি। আমি হলাম শ্রোতা। ঘন্টার পর ঘন্টা বসে শুনতে পারি। অগত্যা বিভাস। আমাদের মধ্যে ওই সবচেয়ে ট্যালেন্টেড ছেলে। একটা উইলস ফ্লেক ধরিয়ে চারটে রিং ছাড়ল। বুঝলাম বুদ্ধির গোড়ায় ধোঁয়া দিচ্ছে।
গল্পটা আমার দাদুর মুখে শোনা। গল্প না সত্যি ঘটনা। সত্যি এই কারণেই বলব আগেকার দিনের বুড়োদের মত আমি দাদুকে কখনো গুল মারতে শুনি নি। আর ঘটনাটা আমার দাদুর নিজের জীবনেই ঘটেছিল।
সেটা ১৯৭০ সাল। আমার দাদু মালগাড়ির গার্ডসাহেবের কাজ করতেন। অত্যন্ত বিরক্তিকর এবং ঝুঁকিপূর্ন কাজ। গার্ডের ছোট বগিতে দাদুকে একদম একা একা থাকতে হত। কিন্তু সংসার প্রতিপালনের জন্য এই কাজ করা ছাড়া আর উপায় ছিল না। পূর্ববঙ্গ থেকে উদ্বাস্তু হয়ে আসার পর সাকুল্যে যে একটা রেলের চাকরি পাওয়া গেছিল সেটাও কম কথা নয়।
এখনকার দিনের মত তখন মুড়ি মুড়কির মত রেল অ্যাক্সিডেন্ট যে হত না সেটা ঠিক তবে রাস্তাঘাটে নিরাপত্তা একেবারেই ছিল না। ওয়াগন ব্রেকারদের রমরমা ছিল। দাদু তাই যতদিন না কাজ থেকে বাড়িতে ফিরত সবাই খুব চিন্তার মধ্যে থাকত।
দাদুর অভিন্নহৃদয় বন্ধু ছিলেন রমাকান্তজেঠু। মানে রমাকান্ত হালদার। ওনাকে আমি কখনো দেখি নি। তবে শুনেছি উনি আর দাদু নাকি গলায়-গলায় বন্ধু ছিলেন। বাবা ওনাকে কেন জানি জেঠু ডাকত। আমিও তাই ওই নামেই ওনাকে ডাকতাম। পূর্ববঙ্গ থেকে দুজনে একসাথে বি.এ. পাশ করেন। তারপর এ দেশে এসে একই সাথে চাকরি নেন। দুজনেই গার্ডের চাকরি নেন।
দাদুরা দুই বন্ধুই খুব ডানপিটে ছিলেন। ভয়ডর কিছু ছিল না। পদ্মার বুকে বাজি রেখে সাঁতার কাটতেন। গাছ থেকে ডাব চুরি করে খাওয়া ছিল রোজকার ঘটনা। দুজনেই সাঙ্ঘাতিক ভাল ফুটবল খেলতেন। দাদু মিডফিল্ডে আর রমাকান্ত হালদার স্টপারে। বাঙ্গাল বলে যারা ব্যঙ্গ বিদ্রূপ করত তাদের উপর সব ঝাল উগড়ে দেবার জায়গা ছিল ফুটবল মাঠ।
রেলের কাজে যেখানেই যেতে হোক না কেন মাসে একদিন দুই বন্ধু দেখা করবেনই। দেখা হলেই অবধারিতভাবে বাংলাদেশ ও শৈশব উঠে আসত। যদিও তখন বাংলাদেশ হয় নি। পূর্ব পাকিস্তান।
এই রমাকান্ত জেঠু মারা গেলেন দুই মালগাড়ির মুখোমুখি সংঘর্ষে। ভয়াবহ অ্যাক্সিডেন্ট। জেঠু অবিবাহিত ছিলেন। দাদু ঘটনাস্থলে যান। মৃতদেহের চিহ্নমাত্র খুঁজে পাওয়া গেল না। দাদু অনেকদিন আশায় ছিলেন জেঠু হয়ত ফিরে আসবেন।
জেঠু আর ফিরে আসেন নি।
তারপর কেটে গেছে অনেক বছর। সংসারের যাঁতাকলে প্রিয়বন্ধুর স্মৃতিও ম্লান হয়ে এসেছে দাদুর মনে। গার্ডসাহেবের চাকরি নিয়ে দাদু আজ ময়ূরভঞ্জ তো পড়শু কোরাপুট করে বেড়াচ্ছেন।
সেবার দাদু মালগাড়ি নিয়ে ফিরছিলেন বস্তার জেলার ওপর দিয়ে। বস্তার ওড়িশার সীমান্তে। বর্তমানে ছত্তিশগড় রাজ্যের অন্তর্গত। বস্তার খনিজ সম্পদে ভরা। বক্সাইট, চুনাপাথর, আকরিক লোহা, কয়লা আরো নানারকম খনিজ সম্পদের ভান্ডার।
দাদুকেও তাই মাঝে মাঝেই ওই পথ দিয়ে যেতে হয়।
বস্তার জেলার কাছে দান্তেওয়াড়া। দান্তেওয়াড়ার ৪০ কিমি দক্ষিণে এশিয়ার বৃহত্তম লৌহখনি বায়লাডিলা বা কিরণডোল। সেখান থেকে আকরিক লোহা বোঝাই মালগাড়ি নিয়ে দাদু ফিরছিলেন বস্তারের ওপর দিয়ে।
বস্তার জেলা খনিজ সম্পদের সাথে সাথে অসামান্য বনরাজি আর জীব বৈচিত্রে ভরপুর। শুনতে ভাল লাগে ঠিকই, কিন্তু সম্পূর্ণ নিরাপত্তাহীন অবস্থায় যখন রাতের জঙ্গল থেকে লেপার্ডের ডাক ভেসে আসে তখন অতি বড় সাহসি দাদুর বুকও কেঁপে উঠত।
সারাদিন বস্তার জেলার অপূর্ব বনসম্পদ, পাখি আর মাঝে মাঝে হাতির পাল দেখতে দেখতে এসেছেন। এ নিবিড় অরণ্যের হৃদয়ে প্রবেশ না করলে যেন তার সৌন্দর্য সঠিকভাবে উপলব্ধি করা যায় না। দুর্গম হলেও আঁকাবাঁকা রেলপথ দিয়ে যখন সাপের মত এঁকেবেঁকে বিশাল লম্বা মালগাড়িটা যায় তখন নেশা লাগে চোখে। নিজেকে আর সভ্যজগতের লোক বলে মনে হয় না। মনে হয় এই সভ্যজগতের ঊর্ধ্বেও আরো কোন যেন সভ্যতার অস্তিত্ব আছে এই পৃথিবীতে।
মানুষের পায়ের ছাপ সেখানে পড়ে নি।
দাদুর চোখে একটু তন্দ্রা মত এসেছিল। হঠাৎ চোখ মেলে দেখলেন মালগাড়ি দাঁড়িয়ে আছে। চারিদিকে গভীর অন্ধকার আর বিপদসংকুল জঙ্গল। দাদু বাইরে বেরিয়ে এলেন। বাইশ বগির মালগাড়ি। এমাথা থেকে ওমাথা দেখা যাবার প্রশ্নই নেই। আজকালকার দিনের মত ওয়াকিটকি সে যুগে ছিল না। দাদু অসহায়ের মত দাঁড়িয়ে থাকলেন। প্রচড গুমোট করেছে আজকে। আকাশটা মেঘে ঢাকা। প্রচন্ড বেগে হালকা কিছু মেঘ কৃষ্ণপক্ষের দ্বিতীয়ার একফালি চাঁদকে একবার ঢাকছে একবার সরে যাচ্ছে।
একে গুমোট তার উপর অন্ধকার। রাতের দিকে বৃষ্টি হতে পারে। দাদু ঘড়ি দেখলেন। সবে নটা বেজেছে। একটানা ঝিঁঝিঁ পোকার আওয়াজ আর মশার গুনগুন। সমস্ত বনটা যেন স্তব্ধতায় বোবা হয়ে আছে। হাতির পায়ের প্রচন্ড শব্দ শোনা গেল আবার চুপ। মনে হয় ওরা কোথাও জল খেতে এসেছে।
দাদু শুনেছিলেন এখানকার বনে হায়না আর চিতাবাঘের খুব উৎপাত। এত গভীর অরণ্যে আদিবাসিদের সংখ্যাও খুব কম। আর পেটের টানে এখন অনেকেই সমতলে নেমে এসে খনিশ্রমিকের কাজ করে। অমানুষিক পরিশ্রম করে। ওদের মেহেনতেই মূলত এই অঞ্চলের খনিগুলো চলছে। কোল, ভীল, মুন্ডা এদের দুর্দশা চোখে না দেখলে বিশ্বাস করা কঠিন। সরকার থেকেও ওদের ওপর যত বেশি করে সম্ভব শ্রমের বোঝা চাপানোর চেষ্টা চলতে থাকে। অথচ নিরাপত্তার কোন ব্যবস্থাই প্রায় নেই।
মাথার ওপরে দাদু দেখলেন পোকার ঝাঁক। অন্ধকারে মশা বলে ভুল হল। পরে বুঝলেন ওরা মৌমাছির মত। গেলবার ওদের কামড় খেয়ে সাতদিন বিছানায় শুয়ে ছিলেন। জ্বর কমছিলই না, এত বিষ। আগের অভিজ্ঞতা থেকে বুঝতে পারলেন নড়লেই কামড়াবে। এবার ঝাঁকে ঝাঁকে আসছে। সবাই মিলে কামড়ালে বাড়িতে লাশ পৌঁছবে।
দাদু নিঃশ্বাস বন্ধ করে কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে রইলেন। একটু পরে পোকার ঝাঁক চলে গেল। দূর থেকে চিতাবাঘের গর্জন শোনা গেল। একজোড়া চোখ জ্বলজ্বল করেই মিলিয়ে গেল। বাইরে থাকা একদম সুবিধেজনক নয়। দাদু ভেতরে ঢুকে দরজা লক করে দিলেন।
কিন্তু এখন তো গাড়ি দাঁড়িয়ে থাকার কথা নয়। আর এই লাইনে মালগাড়িই বেশি যায়। তাই সিগন্যাল না থাকারও কোন কথা নেই। এত রাতে কারও অসুবিধা হবার কথা নয়।
দাদু এসব ভাবতে ভাবতেই মোমবাতিটা জ্বালালেন। কি হয়েছে আলোটাও জ্বলছে না। যদিও মালগাড়িতে এটাই দস্তূর। তাই সঙ্গে টর্চ ও মোমবাতিও রাখতে হয়। দাদু সাতপাঁচ ভাবতে ভাবতে সিগারেট ধরালেন। সঙ্গে আর মাত্র তিনটে সিগারেট আছে। বাঁচিয়ে খেতে হবে।
কামরার মধ্যে অসহ্য গরম। পোকার ভয় থাকা সত্বেও জানালাটা খুলে দিলেন। মোমবাতির আলোয় কামরাটা ভরে গেছে। তবু কেমন যেন একটা ছায়াছায়া ভাব ঘরের ভেতরে। মোমবাতিটা পটপট করছে। আছেও কেবল ওই একটি। বড়জোড় ঘন্টাখানেক চলবে। এর মধ্যে আলো না জ্বললে সারারাত অন্ধকারে থাকতে হবে।
দাদু খেয়ে নিলেন। খেয়েদেয়ে হাতমুখ ধুয়ে আরেকটা সিগারেট ধরাবার তোড়জোড় করছেন এমন সময় হঠাৎ একটা ঠান্ডা হাওয়া দাদুর শরীরের ওপর দিয়ে বয়ে গেল।
দাদু প্রথমে ভাবলেন বাদল হাওয়া। বৃষ্টি আসছে বোধহয়। কিন্তু জানালা দিয়ে কোন গাছের পাতা নড়ার আওয়াজ পাওয়া যাচ্ছে না। অথচ ঠান্ডা আসছে কোত্থেকে?
সাত সতের ভাবতে ভাবতেই মোমবাতিটা হঠাৎ নিভে গেল। হাওয়া নেই কিছু নেই মোমবাতিটা হঠাৎ নিভে গেল কেন? পকেটে হাত দিয়ে দেখলেন দেশলাই নেই। আশ্চর্য একটু আগে প্যান্টের ডান পকেটে রাখলেন দেশলাইটা গেল কোথায়?
সারা শরীরটা দাদুর প্রচন্ড ভারি লাগছে। যেন নড়তে চড়তে পারছেন না। শুধু মাথাটাই যেন কাজ করছে।
কামরার ভেতর নিকষ অন্ধকার। হাতঘড়ির টিকটিক ছাড়া আর কোন শব্দ নেই। দাদু লক্ষ্য করলেন কামরাটা যেন হালকা মেঘের মত ধুলোর কুন্ডলীতে ভরে গেল। চারপাশটা তখন এত কালো লাগল না। যেন সাদা ভাবটাই বেশি চোখে পড়ছে।
এদিকে দাদুর কপালে বিন্দু বিন্দু ঘাম জমে উঠেছে। দাদু বিচ্ছিরি রকমের সাহসী। পদ্মার মাছ দরিয়ায় সাঁতার দিয়েছেন, গভীর দীঘির জলে ডুব দিয়ে কাল মাটি তুলে এনেছেন, লেঠেলদের সাথে ডাকাত ঠ্যাঙাতে চলে গেছেন অবলীলায় – সেই দাদুর বুক দুরদুর করা শুরু হয়ে গেল।
কামরার চারিদিকের সাদা প্রেক্ষাপটে একটা আবছায়া ছায়ামূর্তি দাদুর চোখের সামনে ভেসে উঠল।
বিদ্যুতচমকের মত দাদুর মনে হল দশবছর আগে হারিয়ে যাওয়া বন্ধুর কথা। আরে এই বস্তারের কাছেই তো কোথায় রমাকান্তর মালগাড়ি অ্যাক্সিডেন্ট হয়েছিল না? তিনি নিজেই তো এসেছিলেন দেহ সনাক্ত করতে।
দাদু লক্ষ্য করলেন তালঢ্যাঙ্গা ছায়ামূর্তিটা কাঁপছে। প্রচন্ড ভয়ে দাদুর গলা শুকিয়ে এল। জামাকাপড় ঘামে ভিজে গেছে দাদু বুঝতে পারল। পকেটে হাত ঢোকানোর চেষ্টা করলেন দেশলাই বের করার জন্য।
কিন্তু কোন এক দুরারোগ্য স্নায়বিক অসুখে যেন তার হাত পা অসাড় হয়ে গেছে। তিনি আঙ্গুলটা পর্যন্ত নাড়াতে পারলেন না। রমাকান্তের আত্মা কি তাকে চাইছে? ছায়ামূর্তিটা মনে হল আস্তে আস্তে এগিয়ে আসছে। দাদু সম্পূর্ণ অসহায়তায় রাম-রাম চেঁচিয়ে উঠতে চাইলেন। কিন্তু গলা দিয়ে চিঁ-চিঁ ছাড়া অন্য কোন আওয়াজ বেরোলো না।
এমন সময় কামরার চারিদিকে রমাকান্ত জেঠুর বাজখাঁই গলা ভেসে এল, ‘শেষে তুইও আমাকে ভয় পেলি প্রভাস’?
আর কিছু মনে নেই দাদুর। মাথাটা কেমন ভোঁ-ভোঁ করে উঠল । তিনি অচেতন হয়ে পড়লেন।
যখন জ্ঞান ফিরল দেখলেন তাকে ঘিরে আছে বেশ কিছু লোক। দাদু ধরমর করে উঠে বসলেন।
বাইরে সকাল হয়েছে। ছোট একটা স্টেশনে মালগাড়ি দাঁড়িয়ে আছে। সারারাতের বৃষ্টিতে স্টেশন ভেজা।
ঘাড় ঘুরিয়ে দেখলেন কয়েকজন অপরিচিত লোকের সাথে সেকেন্ড ড্রাইভার বিমলবাবু।
কী ব্যাপার বলুন তো প্রভাসবাবু, শরীর খারাপ নাকি? চোখেমুখে জল দিয়ে কোন সাড় পাচ্ছিলাম না।
না মানে কাল সাড়ে নটার দিকে আমার মাথাটা কেমন করে উঠল তারপর আমার কিছু মনে নেই।
সাড়ে নটা কি বলছেন? মাঝে তিনটে স্টেশন গেছে। এখানেও তো সকালবেলায় স্টেশনমাস্টার আপনাকে পতাকা নাড়তে দেখেছেন।
দাদু কী বলবে বুঝে উঠতে পারছিলেন না।
তারপর বিমলবাবু যা বললেন তার সারমর্ম এইঃ কালকে সন্ধ্যে সাতটার দিকে মালগাড়ির ইঞ্জিন বস্তারের ঘন জঙ্গলের মাঝে হঠাৎ বিকল হয়ে যায়। কিছুতেই চালানো যায় নি। সবাই যখন আশা ছেড়ে দিয়েছে দশটার দিকে আবার হঠাতই ইঞ্জিন চলতে শুরু করে। আরও আশ্চর্য ওই সময় কি তার পরেও নাকি দাদুর হুইসেলের আওয়াজ বিমলবাবুরা শুনেছেন।
তবে সবচেয়ে বড় কথা ট্রেনটা তিনঘন্টা আটকে থেকে নাকি সাপে বর হয়েছে। দুটো মালগাড়ি সিগনালের ভুলে একই লাইনে ঢুকে পড়ে। ট্রেনটা না দাঁড়ালে সঙ্ঘর্ষ অনিবার্য ছিল।
দাদু পাশে তাকিয়ে দেখলেন তার কামরায় মোমবাতিটা আশ্চর্যজনকভাবে এখনও জ্বলছে। ডান পকেটে হাত দিয়ে দেখলেন দেশলাই ঠিক জায়গায় আছে। বিমলবাবু দাদুকে একভাঁড় চা দিয়ে চলে গেলেন। সিগন্যাল হয়ে গেছে গাড়ি ছাড়তে হবে।
এদিকে আমাদের হোটেলের ঘরে এখনও আলো আসে নি। বাইরে প্রচন্ড বৃষ্টি। একটুও কমে নি। ঘরের অন্ধকারে আমরা একে অপরকে অস্পষ্ট ছায়ামূর্তির মত দেখছি।
বুঝলাম এই মুহূর্তে দুটো জিনিস আমার দরকার একটা মোমবাতি আরেকটা দেশলাই। আমি পকেটে হাত ঢুকিয়ে দেশলাই বের করলাম।