গোয়েচালার ডায়েরি

প্রথম দিনঃ (ইয়কসুম থেকে সাচেন)

৬ নভেম্বর ২০২১।

  প্রতিটি ট্রেকের একেকটা বিশেষত্ব আছে। গোয়েচালার বিশেষত্ব এই ট্রেকে আপনি সাত হাজারি, আট হাজারি পর্বতের পায়ের কাছে হাজির হতে পারবেন। নেপালের ট্রেকগুলোতে যেমন হয়- অনেক উঁচু উঁচু পর্বতের খুব কাছে পৌঁছে যাওয়া যায়, এই ট্রেকেও আপনি পান্ডিম, কাঞ্চনজঙ্ঘা, তেঞ্জিংখা, লামা-লামুনে এদের একদম পায়ের কাছে পৌঁছতে পারবেন।

ওয়েলকাম টু কাঞ্চনজঙ্ঘা ন্যাশনাল পার্ক।

  অন্যান্য বছরের মত এবারের ট্রেকের আগেও বাধা কম আসে নি। অক্টোবরের মাঝামাঝি হঠাৎ বৃষ্টিতে উত্তরাখন্ডে বেশ কিছু বাঙালি ট্রেকারের মৃত্যু এবং সেই খবরকে বাংলা নিউজ চ্যানেলগুলোতে সারাদিন ধরে দেখানোর ফলে বাড়ির লোকের মনে অসম্ভব ভয়ের সৃষ্টি হয়েছিল। তাদেরকে বুঝিয়ে সুঝিয়ে তাই নভেম্বরের শুরুতে গোয়েচালায় বেরিয়ে পড়া বেশ কঠিন কাজ ছিল। তারপরে আমার বন্ধুদের পাঁচজনের মধ্যে কেউই এবার যায় নি। তাই আমি সম্পূর্ণ একা এক নতুন দলের সাথে রওনা হয়েছিলাম। আমার নিজের পক্ষেও কাজটা তাই সহজ ছিল না।

  আমি এবারেও ট্রেক দ্য হিমালয়াস বা টিটিএইচ-এর সাথেই গোয়েচালা গেছিলাম। আগের মাসে অক্টোবরের ডেটটা বৃষ্টির জন্য বাতিল হওয়ায় সেই দলের অনেকে নভেম্বরে যোগ দেবার ফলে আমাদের দলে ট্রেকারের সংখ্যা হয়েছিল চব্বিশ জন। এদের মধ্যে নজন ছিল মেয়ে, বাকি ছেলে। দলের সকলের গড় বয়স সাতাশ কি আটাশ। এদের মধ্যে আমিই ছিলাম সবচেয়ে বুড়ো। এগারো দিনের ট্রেক। নয় দিনে হাঁটতে হবে প্রায় নব্বই কিলোমিটার। মুখের কথা নয়। গোয়েচালার প্রান্তর শুধুই বড় বড় পাথরে ঢাকা। তাই সেই পথ চলতে পায়ের আরাম বড়ই কম।

  এন জে পি স্টেশন থেকে ইয়কসুমের পথে যখন রওনা হলাম তখন সকাল প্রায় সাড়ে দশটা বাজে। আমাদের ড্রাইভার বেশ জোরে গাড়ি চালিয়ে নিয়ে চললেন। মেল্লি পার হবার পর যখন সিকিমে ঢুকলাম তখন জোরথাং অব্দি যে রাস্তা আগে মাটির ছিল এবং গাড়িতে সেই পথ পার হওয়াই একটা অভিযান বলে মনে হত, এবার দেখলাম সেই রাস্তার অধিকাংশই পাকা হয়ে গেছে। তাই জোরথাং আমরা বেশ তাড়াতাড়িই পৌঁছে গেলাম। কিন্তু সেদিন পাহাড়ে ভাইটিকা। তাই প্রায় সব দোকানই ছিল বন্ধ। অনেক কষ্ট করে একটা রেস্তোরাঁ খুঁজে আমরা সেখানে দুপুরের খাওয়া সারলাম। ইয়কসুম যখন পৌঁছলাম তখন চারপাশে অন্ধকার হয়ে গেছে।

ইয়ক্সুম।

  আমাদের ট্রেক গাইড রাহুল। সিমলার ছেলে। এখন ধর্মশালায় থাকে। সঙ্গে অন্য দুজন গাইড বুদ্ধারাম আর লোখান ভাই। তারা লোকাল। সকলের সাথে পরিচয় হল। রাহুল হাই অল্টিচুড ট্রেকের নিয়মকানুন আমাদের মনে করিয়ে দিল। প্রতিবার ট্রেকের আগে এসব শুনি আবার ট্রেক শেষ হলে ভুলে যাই। খাওয়াদাওয়া শেষ হল। ইয়কসুমের উচ্চতা প্রায় ছয় হাজার ফুটের মত। এখানেই রাতে বেশ ঠান্ডা লাগছে। আরো ওপরে তেরো হাজার চোদ্দ হাজার ফুটে কিভাবে রাত কাটাবো কে জানে? মিটিং শেষ হলে নরম লেপের ভেতরে ঢুকে পড়লাম। আগামি দশ দিন স্লিপিং ব্যাগের ভেতরে অনেক কসরত করে প্রায় নিদ্রাহীন রাত কাটাতে হবে। আজ তো একটু আরামে শুয়ে নিই।

  সকাল ছটায় চা, সাতটায় ব্রেকফাস্ট, আটটায় রওনা। ট্রেকের সময় নিক্তিতে মাপা। একটুও এদিক-ওদিক হবার উপায় নেই। রাহুল বারবার মনে করিয়ে দিয়েছে পাহাড়ে যে জিনিসটি সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ তা হল সময়। দশ মিনিটের সময় এদিক-ওদিক হলেও পাহাড়ের আবহাওয়া এমন খারাপ হয়ে যেতে পারে যে ট্রেকারদের বিপদ বেড়ে যেতে পারে। তাই সময় কাঁটায়-কাঁটায় মেনে চলতে হবে। এর অন্যথা হবার জো নেই।

  আজ আমরা যাব সাচেন। এর উচ্চতা প্রায় ৭২০০ ফুট। আমাদের আট কিমি রাস্তা চলতে হবে আজ। উঁচুতে উঠতে হবে প্রায় দেড় হাজার ফুট। ঠিকঠাক চললে ঘন্টা ছয়েকের মধ্যে পৌঁছে যাবার কথা। টিফিন বাক্সে লাঞ্চ গুছিয়ে নিলাম। রাস্তায় লাঞ্চ করতে হবে। সাচেন যেতে অনেক দেরি হয়ে যাবে। আমাদের নেপালি সঙ্গীসাথিরা যখন পনির পিঠে মালপত্র গোছগাছ করছে আমরা রাহুল আর বুদ্ধাভাইয়ের সাথে রওনা দিলাম। ছবির মত সুন্দর ইয়কসুমের উপত্যকা ও গ্রাম ছেড়ে আমরা ওপরে উঠতে শুরু করলাম।

  রাস্তার ধারের একটি ম্যাগনোলিয়া গাছে সুন্দর গোলাপি ফুলে ভরে গেছে। বাড়ির চারিদিকের বাঁশের পাঁচিলে লতিয়ে উঠেছে স্কোয়াশ গাছ। তাতে ফুটেছে গাঢ় বেগুনি ফুল। মুরগির ছানারা বস্তার ফাঁক দিয়ে চিক্‌-চিক্‌ করে ডেকে চলেছে। চড়াইগুলো তাদের সকালের ব্যস্ততায় দম ফেলার সময় পাচ্ছে না। দোকানে বসা নেপালি বৌদি এই সক্কালবেলায় গাঢ় লিপস্টিক পরে বসে রয়েছে। আর ঠায় তাকিয়ে আছে আমাদের দিকে। মানুষদের পেছনে রেখে, গ্রামকে পেছনে রেখে আমরা ধীরে ধীরে অরণ্য ও পাহাড়ের মধ্যে মিশে গেলাম। দূর থেকে ইয়কসুমের ছোট্ট গ্রামখানা একটি মিষ্টি হাসি নিয়ে আমাদের দিকে তাকিয়ে রইল। একদিনের সামান্য বিলাসিতা ঠেলে আমরা আমাদের আগামি দশদিনের অনিশ্চয়তার দিকে এগিয়ে চললাম।

  আমাদের বাদিকে অনেক নীচ দিয়ে বয়ে চলেছে রাথোং নদী। পথের উচ্চতা যত বাড়ছে নদী তত দূরে সরে যাচ্ছে। তার জলের শব্দ একটি মৃদু ধ্বনির মত কানে আসছে। সেই শব্দের সাথে জড়িয়ে যাচ্ছে সিকাডাদের একটানা ঝিল্লিডাক। কিছুটা যেতেই সামনে পড়ল অনেকখানি ধ্বসের পাথুরে এলাকা। হপ্তাদুই আগের প্রচন্ড বৃষ্টিতে এই রাস্তা ভারি পাথরে বন্ধ হয়ে ছিল অনেকদিন। আমরা খুব সাবধানে দ্রুত সেই পথ পার হলাম। ধ্বসের এলাকা খুব তাড়াতাড়ি পার হতে হয়। যারা তপোবন ট্রেকে গেছেন তারা জানেন ভোজবাসা যাবার সময় ধ্বসের এলাকা কত তাড়াতাড়ি পার হতে হয়। মাঝেমাঝেই ওপর থেকে পাথর নেমে আসে দ্রুতগতিতে।

  সেই এলাকা ছাড়িয়ে আমরা ঢুকে পড়লাম ঘন নিবিড় অরণ্যের পথে। বোর্ডে লেখা আছে ‘কাঞ্চনজঙ্ঘা ন্যাশনাল পার্ক’। তার পাশে দাঁড়িয়ে সৌরভকে দিয়ে একটা নিজের ছবি তুলে নিলাম। সৌরভ শিলিগুড়ির ছেলে। প্রতি শনি-রবিবার ছুটির দিন পাহাড়ে বাইক নিয়ে বেরিয়ে পড়ে। চারপাশে বিরাট বিরাট ওক, পাইন আর ছোট বাঁশের জঙ্গল। এত গভীর যে সূর্যালোকও কোনো কোনো জায়গায় প্রবেশ করতে পারছে না। আমরা সাবধানে পথ চলেছি। প্রথম দিনের হাঁটা। একটুতেই দম লাগছে। জল খেতে খেতে জিরিয়ে নিয়ে চলছি।

  শিসের আওয়াজ, হ্যাট্‌ হ্যাট্‌ আর গলায় ঘন্টার টুংটাং শব্দ শুনলেই বোঝা যায় পনি আর চমরী গাইয়ের দল আসছে। এরাই পাহাড়ের লাইফলাইন। এরা আমাদের আগামি দশদিনের খাবারদাবার, টেন্ট, স্টোভ, গ্যাস সিলিন্ডার, বাসনপত্র সব বয়ে নিয়ে চলেছে। ভারবাহী পশুরা জলের ধারা দেখলেই দাঁড়িয়ে জল খায়, মাঝেমাঝে বুনো লতা টেনে ছিঁড়ে খায় আবার চলে। তারা আমাদের আগে পৌঁছলেই আমরা গিয়ে সময়মত খাবার পাব। টেন্টে ঢুকে ঠান্ডা কমাতে পারব। মিউলরা এলে পাহাড়ের দিকে সরে দাঁড়াতে হয়। ওরা হেলতে দুলতে আমাদের অতিক্রম করে গেল।

  সাচেন যেতে তিনটি ব্রিজ পড়ে। প্রথম দুটি লোহার সাসপেননশন ব্রিজ, শেষেরটি সিমেন্টের। প্রথমটির ওপর দাঁড়িয়ে নীচে সুন্দর ছোট শুসেখোলা জলপ্রপাত দেখলাম। তার জল নীচে পার্ক নদীর সাথে গিয়ে মিশেছে। লোহার ব্রিজের ওপর দিয়ে নিজেরা হেঁটে গেলে, পনিরা চললে ধাতব শব্দ হয়। সেই শব্দ মিশে যায় প্রপাতের একটানা শব্দের সাথে। এক পাহাড়ি ছেলে মাল টানতে টানতে ক্লান্ত হয়ে ব্রিজের ধারে বসে পড়ল। নিজেদের ওজনের থেকে কত বেশি মাল ওরা প্রতিদিন এই পাহাড়ে টেনে নিয়ে যায়। ভাবলে অবাক লাগে। মাথায় মোটা কাপড়ের চওড়া দড়ির পাড় দিয়ে পিঠের বিরাট ঝুড়ির ভেতরে মালপত্র রেখে ওরা পাহাড়ে পথ চলে।

লোহার ব্রিজ ও প্রেয়ার ফ্ল্যাগ।

  এরপর একঘন্টা চলার পর মেন্টোগাংখোলা নদীর ওপর পরের লোহার ব্রিজ এল। প্রতিটা ব্রিজ অতিক্রম করার পর অনেকটা চরাই অতিক্রম করতে হয়। আবার নতুন ব্রিজের কাছে এসে নীচে নামতে হয়। আপনি বুঝতে পারবেন আপনি এক পাহাড় থেকে অন্য পাহাড়ে প্রবেশ করছেন। এরপর আমরা একটা ছায়াঘেরা জায়গায় বসে লাঞ্চ করে নিলাম। জায়গাটা খুব শান্ত আর ঠান্ডা। কিছুক্ষণ বসার পরেই শরীর দ্রুত ঠান্ডা হয়ে এল। গায়ে জ্যাকেট চাপিয়ে নিলাম। মোবাইলের টাওয়ার চলে গেছে। তাই ফোনাফোনির গল্প শেষ।

  এরপর তৃতীয় ব্রিজ পার হয়ে আর আধঘন্টার মত হেঁটেই আমরা সাচেন পৌঁছে গেলাম। সাচেনে ক্যাম্প করার জায়গা খুব সংকীর্ণ। গায়ে গায়ে তাবু খাটানো হয়েছে। চারিদিকে উঁচু উঁচু ওক পাইনের জঙ্গল। সূর্যের আলোও ঢুকতে পারে না। যথেষ্ট স্যাঁতস্যাঁতে। তারপর কিচেন টেন্ট অনেক নীচে। দুবেলা ওখানেই খেতে যেতে হবে। পৌঁছবার সাথে সাথেই গরম ম্যাগি পেলাম। খিদে ও ঠান্ডায় মনে হচ্ছিল অমৃত খাচ্ছি। আমাদের পাশেই টেন্ট খাটিয়ে আরও চারজনের এক দল চলেছে। ওনারা লোকালদের সাথে ডিল্যাক্স সিস্টেমে গোয়েচালা চলেছেন। একেকজনের নাকি তেত্রিশ হাজার টাকার প্যাকেজ।

সাচেন ক্যাম্পসাইট।

  ওনারা প্লাস্টিকের চেয়ারটেবিলে ডিনার করছেন। একেকজনের আলাদা টেন্ট। খাবার সময় মোমবাতি জ্বালিয়ে দিচ্ছে। মোমবাতির আলোয় মহিলা ও তার মেয়েটির ফর্সা মুখ দেখে তাদের মেমসাহেবের মত লাগছে। পাহাড়ে সবকিছুই ভালো লাগে। মেয়েদের মনে হয় পরী বা সিন্ডারেলা। আমার টেন্টের পার্টনার অন্বয়। ডাক্তারবাবু। আমার চেয়ে বয়সে অনেক ছোট। খুব ভদ্র। অনেক পড়াশুনো। ধর্ম, রাজনীতি, ক্রিকেট নানান বিষয়ে সবার সাথে কথা বলছে। আমাদের দলে একমাত্র অমিতা বলে ব্যাঙ্গালোরের একটি বাচ্চা মেয়ে কোভিড ভ্যাকসিন নেয় নি। ও বিশ্বাস করে ভ্যাকসিন না নিয়ে নিজের ইমিউনিটির ওপর ভরসা রাখা ভালো। ও আয়ুর্বেদ, ঈশ্বর, ইচ্ছাশক্তি এমন অনেক কিছু বিশ্বাস করে। সবাই ওর পেছনে খুব লাগছিল। কিন্তু মেয়েটি খুব নম্র অথচ একবগগা। গত বছর মাইনাস কুড়ি ডিগ্রি তাপমাত্রায় লাদাখে চাদর ট্রেক করে এসেছে।

  এখানে অনেকেই প্রেমিক-প্রেমিকা এসেছে। তারা অনেকেই আবার এক টেন্টে থাকছে। কেবল বদ্রী আর তার স্ত্রী ভাবিয়া বিবাহিত অবস্থায় এক তাবুতে। তাদেরই কেবল একসাথে থাকার ইচ্ছে ছিল না। রাতের খাবার সাড়ে ছটায়। ভাত ডাল আর বেগুনের তরকারি। বেগুনের বড় বড় বীচি। তবে অর্গানিক কিনা জানি না- সেই বেগুনের তরকারিই অত্যন্ত সুস্বাদু লাগল। আর ছিল সিমাই। ডাইনিং মানে ওপরে চালা দেওয়া চারদিক খোলা বাঁশের একটি ভাঙ্গাচোরা আস্তানা। পাশেই নদীর জলে পাইপ লাগানো। ওটাই খাবার আর বাসন ধোয়ার জল। আমাদের কর্মীরা ওই ঠান্ডায় হাত লাল করে বাসন ধুচ্ছে।

  দুটো টয়লেট টেন্ট খাটানো হয়েছে। জঙ্গলের এত ভেতরে যে রাতে গেলে ভেতরে লেপার্ড দেখতে পেলেও অবাক হব না। টাওয়ার পাওয়া যাচ্ছিল। বাড়িতে ফোন করে স্লিপিং ব্যাগের ভেতর শুয়ে পড়লাম। খুব ঠান্ডা লাগছে। কিছুতেই ঘুম আসছে না। অনেক টেন্টেই লোকজন জোড়া জোড়ায় আছে। এমন সময়ে আমার বউয়ের কথা খুব মনে পড়ে। আজ ও এলে মন্দ হত না। কিন্তু ট্রেকে ওর চরম অনীহা। কী আর করা যায়। এপাশ ওপাশ করতে লাগলাম। স্লিপিং ব্যাগে পাশ ফেরাও খুব কঠিন।

  নীচে নেপালিরা ওদের আস্তানায় মোবাইলে গান চালিয়েছে-

  তেরি মেরি গাল্লা হো গ্যায়ি মাশহুর

  ক্যার না কভি তু মুঝে নজরো সে দূর

  কিথে চলি আয়ি তু কিথে চলি আয়ি তু …

  কাটো ক্যায়সি রাতা ও সাঁওরে

  জিয়া নেহি যাতা শুন বাওরে

  কি রাতা লাম্বিয়া লাম্বিয়া রে

  কাটে তেরি সাঙ্গিয়া সাঙ্গিয়া রে…

  ওই ঠান্ডায় আমার যা অবস্থা হচ্ছিল তাতে কিয়ারা আদবানি না হলেও চলবে। শুধু নিজের বউই যথেষ্ট ছিল। অন্বয় ঘুমিয়ে পড়েছে। ওর নাকি স্লিপিং ব্যাগে ঢুকলেই ঘুম এসে যায়। ভাগ্যবান পুরুষ। আমার কখন ঘুম এল মনে নেই। কতবার ঘুম ভাঙ্গল তাও জানি না। ঘুমিয়েছিলাম কিনা তাও সঠিকভাবে বলতে পারব না। সব শান্ত হয়ে গেলে পার্ক নদীর মৃদু আওয়াজ কানে আসতে লাগল।

  আজ প্রথম দিন তো। এই কৃচ্ছ্বসাধন মানিয়ে নিতে একটু সময় লাগবে।  

দ্বিতীয় দিনঃ (সাচেন থেকে সোখা)

৮ নভেম্বর ২০২১।

  সারারাত এপাশ ওপাশ করে ট্রেকে সবসময় ভোরের দিকেই আমার ঘুমটা আসে। মনে হয় যখন একটু ঘুমিয়েছি তখনই চায়ের জন্য ডাক পড়ল। অনেক কসরত করে স্লিপিং ব্যাগ থেকে বেরিয়ে টেন্টের বাইরে এসে দেখি নিচের দিকে ভোরের হালকা রোদ এসে পড়েছে। যারা পাহাড়ের ট্রেক করতে যান তারা জানেন ভোরবেলার এই রোদটুকুর জন্যই প্রত্যেক ট্রেকার অপেক্ষা করে থাকেন। রোদের ওমে শরীর ডুবিয়ে চায়ে চুমুক দেওয়া বা দলের অন্যান্য নতুন পরিচিত ট্রেকারদের সাথে গালগল্প করার মধ্যে দিনের সূচনার যে আনন্দটুকু থাকে তাকে সবাই উপভোগ করতে চায়।

  সবার ওপরে ভোরের এই স্নিগ্ধ আলো এবং ফটফটে আকাশ অনেক সময়ই একটি আসন্ন সুন্দর মেঘমুক্ত দিনের কথা ঘোষণা করে। ভোরাই সেই রোদ তাই আমাদের মনের উৎকন্ঠাকে অনেকটাই কাটিয়ে দিল। সাচেনে যেহেতু চারিদিক প্রচুর গাছপালায় ঢাকা তাই সকাল সকাল এখানে পাখির কোনো অভাব নেই। উচ্ছিষ্ট খাবার ফেলে দেওয়া হচ্ছে তাই সেখানে এসে জুটেছে চেস্টনাট ক্রাউনড লাফিং থ্রাসের দল। তাদের মিষ্টি শিস্‌ ভোরের মাধুর্যকে অনেকটাই বাড়িয়ে দিয়েছে। সকলের ব্যস্ততা, কথাবার্তা, পনিদের চিঁহিঁ এসবের মধ্যেও তাদের ডাক মাঝেমাঝেই কানের আরাম হয়ে ফিরে আসছে। এদের মধ্যে বাচাল পাখি রুফাস সিবিয়াদের ডাক তো আছেই। ভোরবেলার সবচেয়ে ব্যস্ত পাখি সম্ভবত গ্রিন টেইল্ড সানবার্ড। এদের দল এখানে অনেক ভারি। আর আছে পিন টেইল্ড গ্রিন পিজিওন। এদের ছবি তোলার ইচ্ছে ছিল। কিন্তু সুযোগ পেলাম না।

  সকালের সময় খুব কম। তারপর চাপ আসা এবং তার নির্গমনের ব্যবস্থা সকালবেলার সবচেয়ে বড় চিন্তার বিষয়। সারা ট্রেক জুড়ে চলতে থাকে নাম্বার ওয়ান আর নাম্বার টুয়ের গল্প। সকালে আর টয়লেট টেন্টের দিকে যাই নি। সাচেনে নীচে ফরেস্ট হাটের পাশে একটা টয়লেট আছে। ওখানেই পাঁচজনের লাইনে পঞ্চম হয়ে দাঁড়ালাম। শ্রীমুখটিকে যতদিন পারা যায় শৌচকর্মে শুদ্ধ রাখাই একমাত্র অভিপ্রায়। কিন্তু এই ‘প্রসাধনে’ পার হয়ে গেল মূল্যবান পঁয়তাল্লিশ মিনিট। এর মধ্যে ব্রেকফাস্টের জন্য দৌড়াদৌড়ি শুরু হয়ে গেছে। স্যাক গুছিয়ে টেন্ট ফাঁকা করে দিতে হবে। অনেক কাজ বাকি।

  ব্রেকফাস্টে ব্রেড জেলি, পাস্তা আর পোরিজ। এই পাস্তা আর পোরিজ দুটোর কোনোটাকেই আমার সহ্য হয় না। তাই জেলি পাউরুটি খেয়ে রওনা দেবার জন্য প্রস্তুত হয়ে নিলাম। আজ আমরা যাব সোখা। এর উচ্চতা প্রায় ৯৭০০ ফুট। সাত কিলোমিটার রাস্তা। যেতে প্রায় ছ-সাত ঘন্টা সময় লাগবে। আজ আড়াই হাজার ফুট চড়াই আছে। তাই সময় লাগবে অনেক। সকলে একজোট হয়ে ধীরে ধীরে হাঁটা শুরু করলাম।

  শুরুতে সেই ঘন অরণ্যের মধ্যে দিয়ে হাঁটা। এই বনের মধ্যে দিয়ে হাঁটলে চারদিকে আপনাকে ঘিরে রাখবে উঁচু উঁচু ওক গাছ, দেওদার আর হর্স চেস্টনাট গাছের সারি। হিমালয়ের পাখি আর প্রাণীরা এইসব গাছের ওপর ভরসা করেই হাজার হাজার বছর ধরে বেঁচে আছে। রাস্তার ধারের স্যাঁতস্যাঁতে মাটিকে সবুজ করে রেখেছে অজস্র ফার্ন আর অর্কিডের প্রজাতি। পাথুরে রাস্তায় চলতে গিয়ে আপনার পায়ে মাড়িয়ে যাবে হর্স চেস্টনাটের শক্ত ফল। রাহুল বলছিল আগে নাকি এই ফল দিয়ে পাহাড়িরা বাতের ব্যথার তেল তৈরি করত। এখন আর করে না। এখন পাহাড়ে সিডার উড অয়েল খুব চালু হয়েছে। আমাদের মেডিকেল কলেজের ল্যাবরেটরিতেও আমরা সেই তেল স্লাইড দেখতে ব্যবহার করি।

  উঁচু উঁচু গাছ ছাড়াও গোয়েচালার এই রাস্তা জুড়ে ছড়িয়ে আছে শুধুই রডোডেনড্রন গাছ। এখন সেইসব গাছে একটিও ফুল নেই। কিছু কিছু গাছে একটি দুটি কুঁড়ি মাথা তুলতে চাইছে মাত্র। কিন্তু আপনি যদি মার্চ এপ্রিলে এই পথে আসেন তবে আপনার চলার পথ জুড়ে ছেয়ে থাকবে লাল, সাদা, গোলাপি ও হলুদ রডোর ফুল। যত ফুল গাছে ফুটে থাকবে তার চেয়ে কিছু কম থাকবে না মাটিতে। সে এক অপার্থিব সৌন্দর্য। হিলে-বার্সে যাবার অভিজ্ঞতা থেকে আমি আমার চলার পথের সেই লাবণ্য কিছুটা মনে মনে ভাবার চেষ্টা করলাম।

  ঘন্টাখানেক চলার পরেই পার্ক নদীর তীব্র কলতান কানে আসতে লাগল। অনেকটা খাড়াই নীচে নেমে আমরা পার্ক নদীর ব্রিজের কাছে পৌঁছলাম। এটাই সোখা যাবার পথের শেষ এবং সবচেয়ে বড় ব্রিজ। পার্ক নদীটিও বিরাট বড়। অন্য সময় হলে এই নদীর ধারেই দিব্যি একটা দিন কাটিয়ে দেয়া যায়। আমাদের অনেক্ষণের বিরতি মিলল। সেই সুযোগে অনেক ছবি তোলা হল ক্যামেরায়। পার্ক খুবই খরস্রোতা পাহাড়ি নদী। এখন বর্ষার পরপর বলে সে তার সকল পৌরুষ ও ক্রোধ নিয়ে পাথরের ওপর আছড়ে পড়ছে, এ তার দৈনন্দিন নিয়ত রমণ। তার তীব্র রতিতে বড় বড় শিলা ক্ষয়ে যাচ্ছে। মাটি এসে জমছে নীচে। তার ঔরসে পশ্চিম সিকিম সবুজে সবুজ হয়ে আছে।

পার্ক নদী।

  সাসপেনসন ব্রিজের ধার দিয়ে একটানা প্রেয়ার ফ্ল্যাগ লাগানো। তাতে নানান মন্ত্র লেখা। অনেকগুলোতেই বৌদ্ধ তান্ত্রিক গুরু পদ্মসম্ভবের রাগত মুখ। যদিও প্রধান বৌদ্ধ মন্ত্র ‘ওঁম মণিপদ্মে হুঁম’ তবুও সেটি নেপালি ভাষায় লেখার জন্য হয়ত চিনতে পারছি না। চড়াইয়ের পথে নদী এলে যেমন ভালো লাগে, অনেকটা নামার অবকাশ থাকে। তেমনি পরেই থাকে বিরাট চড়াই। এক পাহাড় থেকে মিলে যায় অন্য পাহাড়ে প্রবেশের ছাড়পত্র।

  এর পরে অনেকক্ষণ একটানা ওপরে চলে বড় বড় পাথরে ঢাকা পথ হেঁটে আমরা বাখিমে এসে পৌঁছলাম। এখানে একটি ছোট সুন্দর ফরেস্টের কুঁড়ে আছে। সেখানে দুজন একটি ছোট দোকান চালায়। আমি এককাপ কালো চা খেলাম। অনেকেই ম্যাগি খেল। পাহাড়ের তীব্র রোদে সারা শরীর ঘামে ভিজে গেছিল। তবে যেই না বসলাম ঠান্ডা হাওয়ায় ঘাম শুকিয়ে আবার শীত করতে লাগল। দূরে দেখা যাচ্ছে পাহাড়ের পর পাহাড়ের ঢেউ। রোলিং হিলস। সেই বিন্ধ্যাচলের আড়াল দিয়ে দূরে দেখা যাচ্ছে ইয়কসুম উপত্যকা। এই দুদিনেই অনেকটা দূরে সরে গেছে। কিছুটা নীলচে দেখাচ্ছে। মোবাইল টাওয়ার পাওয়া যাচ্ছিল। বাড়িতে ফোন করে খবর নিলাম।

  একটু দূরে এক বড় পাথরের ওপর উঠে বসলাম। পাশে দুটি চমরী গাই সমানে জাবর কেটে চলেছে। কিছুক্ষণ পরে তাদের মালিক এসে হ্যাট হ্যাট করে ওপরে নিয়ে চলল। তাদের যাবার একটুও ইচ্ছে নেই। কিন্তু ভারবাহী পশুদের ইচ্ছে থাকতে নেই। আমারও যেতে ইচ্ছে করছিল না। না গিয়ে উপায় নেই। কিছু পরেই রাহুলের ডাক এলঃ ‘চলিয়ে চলিয়ে, সোখা আভি আনেবালা হ্যাঁয়’। ও এরকমই বলে। আধঘন্টা বাকি আছে বলে দু-ঘন্টা হাঁটিয়ে নেয়। বাখিমে পাইপের মুখে একটি কল লাগানো। সেখান দিয়ে জল পড়েই চলেছে। আমি বোতল ভরে নিয়ে হাঁটা শুরু করলাম।

  বাখিমের পরে আবার ওক আর আলপাইন বেরির ছায়াঘন পথে আমাদের হাঁটা শুরু হল। কিছুক্ষণ ওপরে ওঠা আবার পরেই নেমে আসা। এভাবে দুই কিমি পথ চলে আমরা যখন শেষের রডোবনের পাশ দিয়ে ক্লান্ত হয়ে ওপরে তাকিয়েছি দেখি সামনেই সোখা। ৮৬০০ ফুট উচ্চতাতে সোখাকে বেশ বড় হ্যামলেটই বলা চলে। চারটি ফরেস্ট গেস্ট হাউস আছে এখানে। আমাদেরটাই সবচেয়ে বড় ও কাছের। বাকিগুলো একটু দূরে। ওপরে একটা ছোট সঙ্ঘারাম আছে। আমরা লাঞ্চ করে সেখানে যাব।

সোখাতে আমাদের টিম।

  দুপুরের মেনু আলুর পাতলা ঝোল আর লুচি। পেটে চরম খিদে। সে যে কী ভালো লাগল বোঝাতে পারব না। আমাদের যাত্রাপথে আরেকদিনও এই অসাধারণ মেনুটি পাব। খেয়েদেয়ে জুতো পালটে কিটো পরে নিলাম। ক্যান্টিনের ছেলেটি দেখি ডাকছে, স্যার মোনাল আয়া হ্যায়। কারো মুখে হয়ত শুনেছ যে আমি পাখির ছবি তুলি। মোনাল! বলে কী! আমি আর দেরি না করে ক্যামেরা নিয়ে ছুট। গিয়ে দেখি সেখানে অনেক লোক। সবাই বাঙালি। তারা যদিও কেউ মোনাল চেনে না কিন্তু উজ্জ্বল পাখিটির দিকে ঠায় তাকিয়ে আছে। দেখি একটি ছেলে অন্যটি মেয়ে। আলো একদম মরে এসেছে। পাখিও অনেএএক দূরে। যাই হোক এখানে এসে মোনাল দেখতে পেলাম তা মুখের কথা নয়। এর ভালো ছবি তো চোপ্তা থেকে নিয়েই এসেছি। হঠাৎ দেখি একটি স্পটেড নাটক্র্যাকার মাটিতে এসে বসল। খুব দুর্লভ পাখি। আগে আমার ছবি ছিল না। ছবি পেয়ে মোনালের ভালো ছবি না পাবার দুঃখ ভুলে গেলাম।

হিমালয়ান মোনাল।

  বিকেলে আলো আরো কমে এল। আমরা গেলাম ওপরের সঙ্ঘারাম দেখতে। যদিও ওটি বন্ধ ছিল। সামনেই বিরাট এক ঝিল। তার ওপরে সারিসারি প্রার্থনা নিশান লাগানো। মঠের পাশেই প্রেয়ার হুইল। আমরা সবাই একবার করে সবকটি চাকতি ঘোরালাম। চাক্তির গায়ে লেখা ওঁম মণিপেনে হুঁম্‌। বিকেল যত বাড়ছিল ততই যেন খুলে যাচ্ছিল আকাশের রং। ডি এস এল আর সঙ্গে আনি নি। মোবাইলেই ছবি তুললাম। সৌরভ আমার ছবি তুলে দিল। দুজনের ছবি একসাথে তুলে দিল ওর বন্ধু দেবপ্রিয়া।

  পনিরা পাশের উপত্যকায় চরে বেরিয়ে ঘাস খাচ্ছে। দূরে আকাশের রং কখনো বেগনি কখনো কমলা। অন্ধকার হয়ে যাবার আগে অব্দি আমরা সেখানে ছিলাম। আমাদের সঙ্গে সঙ্গেই আরেকদল বাচ্চা ছেলেরা চলেছে গোয়েচালা। তাদের একজন স্নো পিজিওনের ছবি তুলে বলছে মোনাল। আসলে চারিদিকে এত মোনাল মোনাল কথা হওয়ায় ওরা ভাবছে হয়ত মোনালেরই ছবি। তার বন্ধুটিকে আমি বললাম, আমি খুব ব্লাড ফেজ্যান্ট দেখব এমন আশা মনে নিয়ে এসেছি। শুধু যে সিকিমের স্টেট বার্ড তাই নয় দেখতেও সে চরম। তাকে ছবি দেখালাম। সে বলল, রাস্তায় দেখলে বা ডাক শুনলে আমাকে জানাবে। ছেলেটি দুটো সোনির মিররলেস নিয়ে এসেছে। ভালো ছবি তোলে মনে হল।

ওম মণিপদ্মে হুম্‌।

  সন্ধ্যেতে সাতটায় ‘হট অ্যান্ড সার’ স্যুপ। ঠান্ডা বাড়ছে। সেই ঝাল স্যুপ খেলে ঠান্ডা অনেকটাই কমে যায়। তার সাথে অন্য এক চেনা গরমও বেড়ে যায় কিন্তু এখানে তো সে গরম ঠান্ডা করার কোনো উপায় নেই! দূরের পাহাড়ে আলো জ্বলে উঠছে। সবচেয়ে দূরে ও উঁচুতে পেলিং দেখা যাচ্ছে। সবচেয়ে নীচে ইওকসুম। আকাশ প্রায় নির্মেঘ। আমাদের কপাল ভালো। আবহাওয়া আমাদের সাথে আছে। খানিক পরে আকাশে একে একে সারা মিল্কি ওয়ে ভেসে উঠল। দূরে চাঁদের আলোয় মাথা তুলেছে পান্ডিমের চূড়া। সবাই ছবি তুলতে উৎসাহিত। আমি রাতের ছবি তোলাকে জোংরি আর থানসিং-এর জন্য গচ্ছিত রেখেছি।

  রাতের খাওয়া জম্পেশ হল। ভাত ডাল আর মিক্সড ভেজ। খেয়েদেয়ে স্লিপিং ব্যাগে ঢুকলাম। বাইরে আমাদের দলের যুবক যুবতীরা গল্প করে চলেছে। ওদের অনেকের মধ্যে সংযোগে নতুন প্রেম সংক্রমিত হচ্ছে। আমিও একদিন এইসব ছেলেমানুষির মধুর প্রেমের স্মৃতি পেছনে ফেলে এসেছি। ওরা আমাদের টেন্টের বাইরে এত জোরে কথা বলছিল যে কিছুটা বিরক্ত লাগছিল। খানিকটা ক্লান্তিতে বাকিটা নীরবতাকে ভালো করে অনুভব করতে পারছিলাম না বলে।

ভূতুড়ে অবয়ব।

  কালকেই ট্রেকের সবচেয়ে কঠিন দিন। জোংরি যেতে হবে। রাহুল তেমনই বলছিল। আজ রাতে যেভাবেই হোক একটু ঘুমের দরকার।  

জোংরি-১

তৃতীয় দিনঃ ৯ নভেম্বর

  সোখায় সকাল হবার সাথে সাথে তাবু থেকে বাইরে বেরিয়ে আমার প্রথম কাজই ছিল আগের দিন সন্ধ্যেবেলায় যেখানে মোনাল দেখেছিলাম সেখানে ফিরে দেখা যে ওরা আবার সকালবেলায় বেরিয়েছে কিনা। দেখলাম সোখার ভোরের প্রথম রোদটাই সেই ফাঁকা মাঠের ওপর পড়েছে। রোদও যথেষ্ট কড়া। পাহাড়ে ভোরের রোদ হলে কী হবে আপনি যত ওপরে উঠবেন সকালবেলার রোদও আপনার চামড়াকে পুড়িয়ে দিতে পারে। ওই রোদে মোনালেরা বেরোবে না, আমি নিশ্চিত। মোনালেরা শিকারী পাখিদের হাত থেকে বাঁচতে ছায়াঘেরা জায়গায় ঘুরে বেড়াতে ভালোবাসে। তাই মোনালের আশা আপাতত ছেড়ে দিলাম।

  এখানে প্রচুর ফেলে দেওয়া খাবার। তাই খেতে কাকের মত উড়ে বেড়াচ্ছে ইয়েলো বিলড্‌ ব্লু ম্যাগপাই। এরা সংখ্যায় এত বেশি আর এত কর্কশ শব্দ করছে যে ভালো ছবি তুলতেও ইচ্ছে করছে না। অথচ আগে এদের ছবি তুলব বলে কত জায়গায় ঘুরে বেরিয়েছি! লার্জ বিলড ক্রো তাড়া করে বেড়াচ্ছে ম্যাগপাইদের। দুদলের মধ্যে সকালের ব্রেকফাস্ট নিয়ে শুরু হয়েছে বিরাট তরজা। এদের মধ্যেই দূরে একদল স্নো পিজিওন সবুজ মাঠের ওপর উড়ে এসে বসছে। খুঁটে খুঁটে খাবার খাচ্ছে। আবার দল বেঁধে উড়ে যাচ্ছে।

  দূরে পরিষ্কার দেখা যাচ্ছে পান্ডিমের চূড়া। আকাশ নির্মেঘ। শান্ত ঠান্ডা সোখার উপত্যকায় একটুখানি ভোরের কুয়াশা কেবল গত রাতের ভুলে যাওয়া স্বপ্নের মত লেগে আছে মাত্র। নভেম্বর মাসে পাহাড়ে আসার এইটে খুব মজার ব্যাপার। ঠান্ডা হয়ত আপনাকে একটু বেশি সহ্য করতে হবে কিন্তু আবহাওয়া এত পরিষ্কার থাকে যে কোনো উৎকন্ঠা থাকে না। যদিও পাহাড়ে নিশ্চিতভাবে হয়ত এমন কিছু বলা যায় না, তবু এখনও পর্যন্ত আবহাওয়া আলো রোদ ও পাহাড় আমার মনের মতই চলেছে।

  কার্ল ইয়ুং বলেছিলেন যে আমাদের অবচেতনায় একটা সত্তা থাকে যাকে আমরা সঠিকভাবে চিনি না। চেতনকে নিয়ে এই দ্বৈত সত্তা বা ডুয়ালিটি আমাদের মানসিক ও চারিত্রিক গঠন অনেকটাই নিয়ন্ত্রণ করে। এখনও বেঁচে থাকা আদিমকালের অনেক প্রজাতির মানুষ বিশ্বাস করেন তাদের মধ্যে একটা ‘বুশ সোওল’ বা ‘বন্য আত্মা’ রয়েছে। আমরা উন্নত মানুষেরা তাকে অবহেলা করি। আধুনিক বিজ্ঞান ও মনস্তত্ত্ব তাকে অনেকাংশেই অস্বীকার করে। কিন্তু ইয়ুং সাহেবের মত আমি নিজেও এই ‘বন্য আত্মা’য় বিশ্বাস রাখি। কারো কাছে সেই আত্মা কুমির, কারো কাছে গাছ, কারো কাছে উত্তাল সমুদ্র আবার কারো কাছে পাহাড়। আমার নিজের মনে হয় আমার ‘বুশ সোওল’ পাহাড়-পর্বত-অরণ্য। পাহাড়ে এলে আমার শরীরের কষ্টকে আর কষ্ট বলে মনে হয় না। অসুস্থ হয়ে এলে একদিনেই সুস্থ হয়ে উঠি। আমি যেন এই নীরব গম্ভীর অব্যক্ত রূপের সাথে কোনোভাবে যোগাযোগ করতে পারি। যদিও সেই যোগ খুবই ক্ষীণ। তবু সে যেন আমার প্রিয়তম সখা। সে কোনোদিন আমাকে খালিহাতে ফেরায় না। আমাদের দুজনেরই একটা পারস্পরিক প্রতীক্ষা থাকে। মিলনের আনন্দ থাকে।

  এবারের পশ্চিম সিকিমের গোয়েচালাও যেন তার অদৃশ্য তরঙ্গ দিয়ে আমার সাথে আলাপ শুরু করে দিয়েছে। আমার অবচেতনা ধীরে ধীরে জলের ওপরের তলের দিকে জেগে উঠতে চাইছে।

  পাহাড়ের ঝোরার জলকে পাইপ দিয়ে নীচে এনে কলের পাইপের সাথে ওরা লাগিয়ে দিয়েছে। কল খুললেই তাই কনকনে পাহাড়ি ঠান্ডা জল পাচ্ছি। ওটাই খাবার ও হাত ধোবার জল। জল হাতে লাগলেই হাত লাল হয়ে যাচ্ছে। ছুরির মত ঠাণ্ডা। তবু সেই জল দিয়েই মুখ হাত ধুয়ে নিলাম। এখানে সকালে আর রাতে একবার করে গরম জল পাওয়া যায়। অথচ এই ট্রেকে একদিনও আমি গরম জল নিই নি কেবল গোয়েচালা সামিটের দিন ছাড়া। এই পাহাড়ের ঠান্ডা জল যে কী সুস্বাদু তা যে না খেয়েছে সে জানে না। আর এই জলে খিদেও পায় খুব। জল খুব ঠান্ডা লাগলে মুখে কিছুক্ষন রাখলে হালকা গরম হয়। আমি সেটাই খাই।

  সকালে ব্রেকফাস্টের পরে সবাই একসাথে জমায়েত হলাম। হেড কাউন্ট হল। আজই আমাদের সবচেয়ে কঠিন পথ চলা। রাহুল তো তাই বলল। আজ সারাদিনে আমাদের প্রায় ৩৩০০ ফুট ওপরে উঠতে হবে। জংরির উচ্চতা প্রায় ১৩০০০ ফুট। একদিনে এতটা উচ্চতায় ওঠা মুখের কথা না। গোটা রাস্তাটাই প্রায় চড়াই। ৯ কিমি পথ চলতে হবে। আট নয় ঘন্টা তো কম করে লাগবেই। পথে কোথাও জল পাওয়া যাবে না। তাই দুটো এক লিটারের জলের বোতল ভরে নেওয়া হল। সঙ্গে রইল প্যাকড লাঞ্চ।

  আধঘন্টার মত হেঁটে আমরা প্রায় পাহাড়টার ওপরে চলে এলাম। পেছনে ফিরে দেখি সোখাকে একটা ছোট রঙিন পোস্টকার্ডের মত দেখাচ্ছে। আমরা এরপর আবার রডোবনের ভেতরে প্রবেশ করলাম। চারিদিকে শুধুই রডো, ওক, হর্স চেস্টনাট আর ফারের বন। বার্চ বা ভূর্জপত্র গাছের সংখ্যা খুবই কম। নেই বললেই চলে। মাঝে মাঝে কিছু ম্যাপল গাছ চোখে পড়ে। তাদের সংখ্যাও খুব বেশি নয়। বছরের বিভিন্ন সময়ে ম্যাপল পাতার রঙ পালটায়। কখনও হলুদ কখনও লাল। মাটিতে কিছু কিছু লাল ম্যাপলের পাতা পড়ে আছে। ফার গাছগুলোর পাতাবাহার ছোট ছোট ছাতার মত হয়ে আছে। তাদের পাতাগুলো পেছনের দিকে রঙ পালটায়। যদি দেখেন তাদের মাটিতে পড়া পাতার পেছন দিকে সাদাটে রঙ তবে বুঝবেন সেগুলো সিলভার ফার। আর যদি দেখেন লালচে-হলদেটে তবে তারা গোল্ডেন ফার। সিকিমে সিলভার ফারই বেশি চোখে পড়ে। উচ্চতা যেই বাড়তে লাগল তেমনি ধীরে ধীরে চোখে পড়তে লাগল পাইনের সারি।

  পাহাড়ের নিচে যেমন মোটা বাঁশ, ওপরে তেমনি ছোট সরু বাঁশের জঙ্গল। রাহুল বলছিল জংরিতে গিয়ে যে গেস্ট হাউস দেখব তা নাকি অনেকটাই সেই বাঁশ দিয়ে তৈরি। সিকিমের লোকেরা যে স্থানীয় মল্ট দিয়ে বিয়ার তৈরি করে তার নাম ছাং। সেই ছাংকে এরা বড় বাঁশের কোটরের মধ্যে রেখে ছোট বাঁশের চোঁচকে স্ট্র বানিয়ে তা দিয়ে টেনে টেনে খায়। যখন রডোর ফুলে ভরে যায় চারিদিক তখন লাল রডোর ফুল দিয়ে এরা সুন্দর পানীয় বানায়। সেই পানীয়কেও একইভাবে খায়। রাহুল বলছিল লাল রডোর ফুল দিয়েই এই পানীয় হয়। যদিও সিকিমে আরো ৩৫ রকমের রডোডেনড্রন ফোটে কিন্তু আর কোনোটিকেই সম্ভবত পানীয় হিসেবে ব্যবহার করা যায় না। আমরা যখন রূপকুন্ড ট্রেকিং করতে গেছিলাম তখন প্রথম দিন ট্রেকিং শেষে যখন দিদনা পৌঁছলাম ওখানকার স্থানীয়রা আমাদের লাল গুরাসের সরবত দিয়ে অভ্যর্থনা করেছিল।

  একটানা যেহেতু ওপরে ওঠা তাই মাঝেমাঝে জল খাবার জন্য দাঁড়াতেই হয়। যদিও ফেদাং যাবার আগে অবধি প্রধান বিরতি আছে তিন জায়গায়। ঘন্টা দেড়েক চলার পরেই আমরা প্রথম বিরতিতে এসে গেলাম। ওক ও রডোবনের ভেতর সুন্দর একটা খোলা জায়গা। তাতে একটি কাঠের চেয়ার পাতা আছে এক কোণে। সবাই সেখানে বসে ছবি তুলতে লাগল। ঘন উঁচু গাছের ছায়ায় এলাকাটি ঢাকা বলে আলো খুবই কম। আমাদের মধ্যে আমান আসানসোলের ছেলে। ওর ছবি তোলা হাঁটা কি অনর্গল কথা বলে চলা কোনো কিছুতেই উৎসাহের কোনো অভাব নেই।

  চকোলেট, প্রোটিন বার আর জল খেয়ে আবার হাঁটা শুরু হল। এবার আমাদের গন্তব্য ‘বড়া পাত্থর’। ওখানেই পরবর্তী বিশ্রাম। ঘন্টাখানেক হেঁটেই আমরা সেখানে পৌঁছে গেলাম। বিরাট উঁচু এক পাথরের সামনে বসার জায়গা। সবাই সেখানে বসে ছবি তুললাম। কোন কালে এই বিরাট পাথর সম্ভবত ধ্বসের ফলেই এখানে এসে আটকে গেছে। সেদিন থেকেই এই ‘বড়া পাত্থর’ পথিকদের ক্ষণিকের বিরতি আর বিশ্রাম দিয়ে চলেছে। টুং টাং শব্দ আসছে। মিউলের দল আমাদের অতিক্রম করে গেল। রাহুল বলল আমরা ফেদাং-এর পথে প্রায় অর্ধেক চলে এসেছি। শুনে মনে শান্তি এল। খানিক পরে আবার হাঁটা শুরু হবে।

বড়া পাত্থর।

  গোয়েচালা যারা গেছেন তারা জানেন যে সোখা থেকে ফেদাং যাবার এই পুরো রাস্তাটাই প্রায় কাঠের লগের সাহায্যে তৈরি করে দেয়া আছে। তাতে চলার অনেকটা সুবিধে হয়। যদিও তার মাঝে মাঝে পাথরের কোনো অভাব নেই তবু চলায় কিছুটা আরাম মেলে। আমি শেষে বুদ্ধাভাইয়ের সাথে গল্প করতে করতে হাঁটছিলাম। চারিদিকে চেস্টনাট রঙের এক ধরনের গুল্ম ছেয়ে আছে। তাদের ওপর ভোরের শিশির জমে ছোট ছোট বরফের বিন্দু হয়ে গেছে। বুদ্ধাভাই বলছিল এই গুল্মগুলোও রঙ বদলায়। আমাদের এই মধ্য নভেম্বরের ট্রেকের পরেই টিটিএইচ তার এবছরের মত গোয়েচালা ট্রেক বন্ধ করে দিচ্ছে। বিকাট ও লোকালদের মাধ্যমে কিছু কিছু ট্রেক যদিচ এখনও চলবে। তবে ততদিনই যতদিন এই পথে পনিরা চলতে পারবে। পথে বরফ জমে গেলে পনিদের পা পিছলে যায়, তারা চলতে পারে না। তাই এবছরের মত ট্রেক আর কিছুদিনের মধ্যেই হয়ত বন্ধ হয়ে যাবে। আবার সামনের বছর মার্চ- এপ্রিল থেকে শুরু হবে বসন্তকালীন ট্রেক।  

  অনেক হ্যাঁচোড়প্যাঁচোড় করে অবশেষে আমরা ফেদাং-এ পৌঁছে গেলাম। ফেদাং-এর উচ্চতা ১০,৫০০ ফুট। দূরে পাহাড়ের রেঞ্জ ঝকঝকে দেখাচ্ছে। বরফে সাদা পাহাড়ের চূড়া। মাঝে মাঝে তাদের যে অংশ খাড়াই তাতে বরফ জমতে পারে না। পিছলে যায়। তাই সেই অংশ পাথুরে। সেই অবারিত নীল আকাশ আর সাদা পাহাড়ের মাথা উঁচু দেখে আমার স্বদেশ সেনের কবিতার কথা মনে এলঃ-

‘পায়রা পিছলে যাবে

এমনি হ’য়েছে আকাশ

রোদ এমন

যে কাগজে ছাপানো যায়’।

  পা ছড়িয়ে বসে আছি। আমার পাশে এসে বসল দিবিয়া আর সঞ্জনা। দিবিয়া(দিব্যাঙ্গী) ব্যাঙ্গালোরের মেয়ে। ল’ পড়ছে। আঠারো বছর বয়স মাত্র। ওর বাবা নেভিতে ছিলেন। এখন অবসর নিয়েছেন। দিবিয়া গত দুবছর ধরে ঘোড়া চালানো শিখছে। ওর কাছে শুনছিলাম কিভাবে ঘোড়া চালাতে শেখার আগে ঘোড়াদের মন বুঝতে হয়। ঘোড়া যদি আপনাকে গ্রহণ না করে আপনি কিছুতেই তার পিঠে চড়তে পারবেন না। সবে আঠারো। ওর বাড়ির লোক ওকে ছেড়ে দিয়েছে ওর ভবিষ্যতের একা ইচ্ছের কাছে। বন্ধুদের কাউকে না পাওয়ায় একাই চলে এসেছে। আমি বসে আমার মেয়ের কথা ভাবছিলাম।

পায়রা পিছলে যাবে, এমনই হয়েছে রোদ।

  ফেদাং-এ অনেকটা খোলা সমান মাঠ। একটা ম্যাগি পয়েন্ট আছে। সেখানে দুজন ম্যাগি আর চা-কফি-অমলেট বিক্রি করছে। বিক্রিবাট্টা করে আবার ফিরে যাবে সোখায়। প্রতিদিনই তাদের আসা-যাওয়া। এতটা পথ প্রায় ছুটেছুটে ওঠানামা করে। খাবার কিছু ফেলা হচ্ছে। তাই খেতে আসছে গ্রে ক্রেস্টেড টিট, হোয়াইট ব্রাউড ফুলভেট্টা আর রুফাস ভেন্টেড টিট। এখানে এরা মানুষকে এত কম ভয় পায় যে প্রায় এক গজের মধ্যে এসে ছবি দিচ্ছে। পালাচ্ছে না। কিন্তু প্রচন্ড চঞ্চল ও অস্থির। এক সেকেন্ড স্থির থাকছে না। ফেদাং-এ যথেষ্ট ঠান্ডা। ওপরে দেখা যাচ্ছে দেওরালি টপ। মনে হচ্ছে এই তো উঠে পড়ব। কিন্তু জানি পাহাড়ে এলে সবকিছু অলীক, স্কিউড দেখায়। যতটা উচ্চতা মনে হয় আপাতভাবে বাস্তবিক তার উচ্চতা অনেকটাই বেশি। আমরা অর্ধেক পথ এসেছি মাত্র। আরো অর্ধেক যেতে হবে। কখন পৌঁছব কে জানে? এতদূর আসতেই শরীরের শক্তি যেন সব শেষ হয়ে গেছে।

দেওরালি টপ।

  ফেদাং থেকে শুরু হল তীব্র চড়াই। উঠছি তো উঠছিই। ওঠার যেন কোনো শেষ নেই। আস্তে আস্তে রডোর বন শেষ হয়ে এল। বড় গাছের সারি শেষ হয়ে এল। বুঝতে পারলাম আমরা ক্রমশ আরো উঁচুতে গুল্ম জাতীয় গাছের এলাকায় প্রবেশ করে ফেলেছি। হাঁটতে হাঁটতে হাঁপিয়ে নিচের দিকে তাকালে দেখতে পেলাম পায়ের নিচে শেষ দুপুরের মেঘ। তারা ধীরে ধীরে এবার ওপরে উঠে আসবে। এতদিন পরে মনে হল আমরা সত্যিই যেন অনেকটা ওপরে চলে এসেছি। ঈশ্বরের কাছাকাছি। আমাদের সামনে শুধুই পাহাড়। পায়ের নিচে মাটি। আমাদের জড়িয়ে রেখেছে ঠান্ডা বরফভেজা হাওয়া আর শীতল রোদ।

  যে সময় মনে হচ্ছিল আর হয়ত উঠতে পারব না তখনই দেখি দেওরালি টপ এসে পড়েছে। এসে আর কী বলব মুগ্ধ হয়ে কিছুক্ষণ তাকিয়ে থাকলাম। আমাদের সামনে সম্পূর্ণ একটা পাহাড়ের রেঞ্জ আর প্রচুর চূড়া ঝকঝকে রোদে ঠায় দাঁড়িয়ে আছে। এ দৃশ্য যে না দেখেছে সে বুঝবে না। একে ভাষায় ফুটিয়ে তোলা যায় না। ক্যামেরার সীমাবদ্ধতায় এর ছবি তোলাও অসাধ্য। একে শুধু মনের চোখ দিয়ে দেখতে হয় আর স্মৃতিতে ধরে রাখতে হয়। অন্তত যতদিন স্মৃতি জীবিত থাকে।

  হাড়ভাঙ্গা পরিশ্রমের পর এই দৃশ্য দেখে সবাই খুশিতে পাগলের মত ছবি তুলতে লাগল। বাদিক থেকে ডানদিকে যে পর্বতচূড়াগুলো দেখা যাচ্ছিল তাদের নাম যথাক্রমে- কোকথাং, রাথোং, কাব্রু সাউথ, কাব্রু লি, কাঞ্চনজঙ্ঘা, গোএচা পিক, পান্ডিম, তেঞ্জিং খা, জপুনো, লামা-লামুনে ও মাউন্ট নার্সিং। আমাদের ভাগ্য ভালো আমরা এত স্পষ্ট প্রত্যেকটা চূড়াকে দেখতে পেলাম। রাহুল বলছিল, ও এর আগে গত মাসে যাদের নিয়ে এসেছে তাদের একদল সারা ট্রেকে একটি চূড়াও দেখতে পায় নি। টানা নয়দিন আকাশ মেঘে ভার হয়ে ছিল। আর আমাদের বেলায় তো আগেই বলেছি, এমন রোদ যে কাগজে ছাপানো যায়। আমরাও ক্যামেরা বের করে মনের আনন্দে অনেক ছবি ছাপিয়ে নিলাম।

  রাহুল বলছিল এই তো চলেই এসেছি। ও যেমন বলে। কিন্তু তারপরেও অনেক পথ হেঁটে অনেক চড়াই উৎরাই অতিক্রম করে রাস্তার ওপর দিয়ে বয়ে চলা পাহাড়ি নদীতে জুতো ভিজিয়ে যখন শেষ রডোবন পার হয়ে শরীরের সর্বশেষ গ্লুকোজের অণুটিকেও পুড়িয়ে ক্যালোরি বের করে ফেলেছি তখন দেখি সামনেই সন্ধ্যের মরা আলোয় উঁকি দিচ্ছে জোংরির কুঁড়ে আর নানান রঙের টেন্ট।

  আজ সারাদিন হেঁটে এসে বুঝলাম কেন বহুলোক গোয়েচালা এসে মাঝপথে শুধু জোংরি করেই ফিরে যায়। সারাজীবন যত চড়াইয়ের পথ চলেছি এই রাস্তার পথশ্রম আর অবশ্যই বদলে যাওয়া সৌন্দর্য আমি সারাজীবনেও ভুলব না।

জোংরি-২

১০ নভেম্বর

  জোংরিতে যখন এসে পৌঁছলাম বিকেলের আলো মরে এসেছে। জোংরিতে এত ঠান্ডা হাওয়া চলে যে কিছুক্ষণ দাঁড়াতে না দাঁড়াতেই গায়ের সব গরম শুষে নিয়ে সেই রাক্ষুসে ঠান্ডা আমাকে অবসন্ন করে ফেলল। তার সাথে হঠাৎ করেই বুঝতে পারলাম দপ্‌ দপ্‌ করে মাথা ব্যথা শুরু হয়ে গেছে। একে তো চলার ক্লান্তি তারপর একদিনে প্রায় ৩,০০০ ফুট ওপরে উঠেছি তার ওপর এই হাড় কাঁপানো ঠান্ডা- সব মিলে যেন কিছুক্ষণের মধ্যেই শরীর কাহিল হয়ে এল। পাহাড়ের এত উঁচুতে মাথাব্যথা AMS বা অ্যাকিউট মাউন্টেন সিকনেস-এর লক্ষণ হতে পারে। সারাদিনে জল তো তেমন কিছুই খাওয়া হয় নি। তবে আমার মনে হল তেমন কিছু নয়, এটা সারাদিনের ক্লান্তি আর ঠান্ডা থেকেই হয়ত হচ্ছে। পাহাড়ে হাঁটতে আমার কোনো অসুবিধে হয় না কিন্তু দেখেছি প্রচন্ড ঠান্ডা আমাকে মাঝেমাঝেই কাবু করে ফেলে।

  জোংরিতে পাশাপাশি যে দুটো গেস্ট হাউস ও কিচেন হাট তার পাশের উঁচু জায়গাটিতেই আমাদের তাবু পাতা হল। পাশ দিয়ে বয়ে চলেছে ছোট পাহাড়ি ঝোরা। তার মুখে পাইপ লাগিয়ে সেই জল দিয়েই সব কাজকর্ম চলছে। এই ছোট জলধারাটিই জোংরির জীবনরেখা। স্থানীয়রা বারবার বলে দিয়েছে কেউ যেন ওপরে নদীর ধারে টয়লেট করে কোনোভাবেই জলকে দূষিত না করে। ওপরে নাকি পাহারাদার আছে। ধরা পড়লে কড়া শাস্তির ব্যবস্থা । মনে হল এটা নেহাতই ভয় দেখানো। তবে আমরা যারা নিয়মিত পাহাড়ে আসি তারা অন্তত এই নিষেধাজ্ঞাটুকু সবসময় মেনে চলি।

রহস্যময় জোংরি।

  জোংরি একটু নিচু জায়গায়। চারিদিকে পাহাড়। সামনে অনেকটা খোলা জায়গা। খাইবার পাস। সেখান দিয়েই দস্যুর মত ঠান্ডা হাওয়া তরবারি হাতে ছুটে আসে। নিচের দিকে কিছুটা সমতল। সেখানেও অনেকে তাবু খাটিয়েছে। নানান বাহারি তাবু। নানান রকম রং। অভিজাত মহিলাদের বিলাসী অন্তর্বাসের মত। তাদের পাশে পনিরা চরে বেড়াচ্ছে। শুকনো বাদামি ঘাস খেয়ে বেড়াচ্ছে। শ্যামলিমা এখানে বড়ই কম। এই ১৩,০০০ ফুট উচ্চতায় গাছের পাতার রং মূলত চেস্টনাট, লালচে-খয়েরি। যে কটা রডোর বন আছে তাদের পাতাতেও সবুজের আভা কম। চারপাশ মূলত ঊষর। ধুসরতাই এর সৌন্দর্য। পাহাড়ের এটাই রূপ। সবুজের মায়া কাটিয়ে আপনি ধীরে ধীরে খয়েরির দিকে ফিরে যাবেন। শেষে শুধুই সাদা আর সাদা আপনার চোখকে ঝলসে দেবে।

  জোংরি যেহেতু একটু নীচে তাই এখান থেকে তেমন কোনো পাহাড়ের চূড়া সেভাবে দেখা যায় না। ৩৬০ ডিগ্রি বিস্তৃত পাহাড়ের চূড়া দেখতে হলে আপনাকে জোংরি টপে যেতে হবে। যেটা আরো আট-নয়শ ফুট উঁচুতে। ওখান থেকে সূর্যোদয় দেখা এক অনির্বচনীয় অনুভূতি। ঠিক আছে যে আমরা কাল সকাল সাড়ে চারটার সময় বেরোব। কিন্তু আজ আমার যা অবস্থা আমি ঠিক করলাম সকালে আর যাব না। সামনে এখনও অনেকটা হাঁটা বাকি। কালকের দিনটা আমি পুরোপুরিই বিশ্রাম নেব। কিন্তু আজ এসে মনে হয় গোটা ট্রেকে এটাই আমার সবচেয়ে বড় আপসোস হয়ে রয়ে গেল। গোয়েচালায় এসে সব কিছুই করলাম। শুধু জোংরি টপে যেতে পারলাম না। এ হতাশা আমার কোনোদিন যাবে না। তবে কিছু পাবার জন্য কিছু তো ছাড়তে হয়। শরীর বেশি খারাপ হলে মুশকিলে পড়ে যেতাম।

  যতগুলো লেয়ার ছিল গায়ে চাপিয়ে নিলাম। তাও ঠান্ডা যেন মানতে চাইছে না। সন্ধ্যে হয়ে গেছে। বাইরের তাপমাত্রা শূন্যের নীচে নেমে গেছে। নদীর জলের ওপর বরফের স্তর ধুলিকণার মত একটু একটু করে জমে উঠছে। এখানে এই নভেম্বরে এত ঠান্ডা যে প্রাণপ্রবাহ অনেক নীচে চলে গেছে উষ্ণতার খোঁজে। পাখির ডাকও তেমন শোনা যায়। বুনো জন্তুর আওয়াজ প্রায় কানেই আসে না, কেবল পনিদের চিঁহিঁ ছাড়া। দুপুরের পর থেকেই নীচের থেকে যে ভারি কুয়াশা বা মেঘ ওপরে আসতে থাকে সন্ধ্যের মধ্যেই তা সারা জোংরিকে ঢেকে দেয়। তাই সন্ধ্যে এখানে সাদা-কালো। পাহাড়ে আকাশের অস্তরাগ আপনি খুব ভাগ্যবান না হলে দেখতে পাবেন না। তবে রাতে শীতকে ভয় না পেয়ে যদি বাইরে আসতে পারেন তবে দেখবেন, হাওয়া গেছে কমে, ঠান্ডা কনকনে কিন্তু নির্মেঘ পরিষ্কার আকাশে ঝকঝকে উজ্জ্বল তারারা তাদের প্রচন্ড বিপুল শক্তিভারকে মৃদু মৃদু মৃদু করে আপনার দিকে তাকিয়ে আছে। রাতের আকাশ যে কত অপূর্ব তা আমরা শহরের লোকেরা জানিই না। পাহাড়ের খোলা প্রান্তরের কাছে এসে দাঁড়ালে দেখতে পাবেন রাতের আকাশ সত্যি সত্যিই পৃথিবীর খুব কাছে নেমে আসে।

ওপরে মিল্কি ওয়ে নীচে জোংরি টপ।

  আকাশের এই তারাদের নিয়ে মানুষের কত কল্পনা। কবির কত কাব্য। বৃন্দাবনে প্রথম বাঁশি বাজছে। গোপিনীরা তখনও জানে না সেই বাঁশি কোথা থেকে আসছে। জানে না কে সেই বাঁশি বাজাচ্ছে। কারো মনে হচ্ছে দক্ষিণ পবন থেকে আসছে। কারো মনে হচ্ছে গিরিগোবর্ধনের চূড়া থেকে আসছে। মনে হল অস্তাচলের পথে আঁচল বিছিয়ে কেউ সেই বাঁশি বাজাচ্ছে। বাঁশির শব্দে যমুনার ঢেউয়ের সুর। ক্রমে সমস্ত চরাচর জুড়ে, ফুলে ফলে অরণ্যমর্মরে, অন্তরে-বাহিরে সেই বাঁশি বাজতে লাগল। মনে হল আকাশের সবকটি তারা যেন সেই বাঁশির ছিদ্র। বাঁশি কী বলছে কেউ বুঝতে পারল না। বাঁশির উত্তরে হৃদয় কী বলতে চাইছে তাও কেউ বুঝতে পারল না। শুধু এক অলোকসামান্য শ্যামস্নিগ্ধ মরণের আকাঙ্খায় অশ্রুজলে ভেসে তাদের হৃদয় উৎকন্ঠিত হয়ে উঠল।

  আকাশের প্রতিটি তারা যেন সেই বাঁশির ছিদ্র। আহা! কল্পনা! জোংরিতে প্রথমরাতে কিছুতেই ঘুম আসছে না। অন্বয় যে শুলেই ঘুমিয়ে পড়ে সেদিন তারও মনে হয় ঘুম ভেঙে যাচ্ছে মাঝেমাঝে। এত জোরে হিসি পেয়েছে যে না ঊঠলেই নয়। অনেক মনের জোর লাগিয়ে স্লিপিং ব্যাগ থেকে বেরিয়ে বাইরে এলাম। সারা আকাশ জুড়ে যেন বাঁশির ছিদ্র! কী নীরব শীতল রাত। একটুও বাতাস বইছে না। সেই রাতে কালো আকাশ অগুন্তি তারার সাথে আমাকে যেন ঘিরে ধরল। কোথায় গেল শরীরের কষ্ট, কোথায় গেল বিষাদ! মনে হল জীবনে যেদিন মৃত্যু হবে যেন এই পাহাড়ের গায়েই কোথাও হয়। হতে পারে কোনো রাস্তার ধারে। কোনো নদীর পাশে। আকাশ জুড়ে এমনই যেন তারা থাকে সেদিন। অনন্তসুন্দর যা অব্যক্ত ও অবোধ্য তার কাছে এসে দাঁড়ালে জীবনে যে মৃত্যুচেতনা জেগে ওঠে- এই অনুভূতি তার আগে আমার কখনও হয় নি ।

  আমাদের দলের ২৪ জনের মধ্যে সকালে আটজন মাত্র জোংরি টপে গিয়েছিল। সৌরভ ওর মোবাইলে খুব সুন্দর একটা টাইম ল্যাপ্স ভিডিও তুলে এনেছে। এনে আমাদের দেখাচ্ছিল। মন খারাপ লাগল। একটু মনের জোর বাড়ালে তো দিব্যি চলে যেতে পারতাম। বদ্রী আর ভাবিয়ার আজ বিয়েবার্ষিকী। ওরা আজকের দিনটা সুন্দর জোংরি টপে সূর্যাস্তের সাথে শুরু করেছে। এমন স্মৃতি সারাজীবনে ভোলা সম্ভব? ওরা ওদের দুটো বাচ্চা ছেলেকে রেখে ট্রেক করতে এসেছে। যারা ট্রেক করার অপারগতা হিসেবে ঘর-সংসার দেখান তারা ওদের থেকে শিক্ষা নিতে পারেন। আমরা ঘর আর বাচ্চাদের অজুহাত দিয়েই ধীরে ধীরে নিজেরা বেঁচে থাকতে ভুলে যাই।

  সকালে ব্রেকফাস্ট খেয়ে একটু দূরে ক্যামেরা নিয়ে মাটির ওপরে বসলাম। স্নো পিজিওনেরা নানান দলে এসে এসে বসছে আবার উড়ে চলে যাচ্ছে দূরে। দলবদ্ধ হয়ে তাদের উড়ে যাবার দৃশ্যটি খুব সুন্দর। সোখা থেকে শুরু করে থানসিং সর্বত্রই এই পাখিরা প্রচুর সংখ্যায় আপনার চোখে পড়বে। আমি আকাশে এখনো পর্যন্ত কোনো শিকারি পাখি এমনকি বিয়ার্ডেড ভালচারকেও দেখলাম না। তাই মনে এরা এখানে প্রায় প্রতিদ্বন্দ্বিতাহীন নিরাপদ জীবনযাপন করে।

প্রকৃত পায়রা।

  আমাদের দলে যে কয়টি জোড় আছে তাদের মধ্যে একটি জোড় সবচেয়ে ঘনিষ্ঠভাবে আছে। অথচ তাদের মধ্যের সম্পর্কটাই মনে হয় সবচেয়ে জটিল। হয়ত কিছুটা সমস্যার মধ্যে দিয়ে চলেছে। একজন নদীর অন্যপারে রোদে পিঠ দিয়ে বই পড়ছে। আরেকজন অন্য দুই মেয়ের সাথে নদীর এপারে বসে লোকদেখানো খেজুর করছে। তাদের সম্পর্কের উৎকন্ঠা আমাদের দলের মধ্যে কিছুটা রসিকতা কিছুটা জিজ্ঞাসা হয়ে সারা ট্রেকেই লেগে ছিল।

  আমাদের সঙ্গে সঙ্গেই সেই মিষ্টি বউদি তার মিষ্টি মেয়ে আর জবর স্বামী গোয়েচালার পথে চলেছে। তারা নীচের টেন্টে আছে। বউদিকে তাই বেশি দেখছি না। এদিকে বউদির শ্রীময়ী মুখখানি বেশি না দেখলেও প্রাণে বিরহ জাগে। জোংরিতে এতই ঠাণ্ডা যে বাইরে রোদেও কনকনে হাওয়ায় বেশিক্ষণ বসে থাকা যায় না। কিচেন টেন্টে গিয়ে যে একটু আগুনের পাশে বসব তারও উপায় নেই। সেখানে আমাদের ঢোকা একদম বারণ। তাই বাইরেই কাঠের পাটাতনের ওপর বসে রইলাম। এর মধ্যে ‘এইচ এম আই’-এর চোদ্দদিনের অ্যাডভান্সড ট্রেনিং নিয়ে ফিরে আসছে অনেক পর্বতারোহীরা। তাদের মুখ সানবার্নে কয়লার মত কালো হয়ে গেছে। নাকের মাথাটা এমন ক্ষতবিক্ষত যে দেখে মনে হবে মারামারি করে এসেছে। তাদের মধ্যে অনেকেই বাঙালি। পাহাড়ে অভিযানে বাঙ্গালিরা থাকবে না তা আবার হয় নাকি! এইচ এম আই-এর হেড অফিসও তো দার্জিলিং-এ। রুদ্র বলে একজনের সাথে আলাপ হল। ওরা এবার ক্যাম্প করেছিল রাথোং গ্লেসিয়ারের ওপর। যাবার আগে হাত নাড়িয়ে বিদায় জানিয়ে গেল।

  চোদ্দদিনের সাঙ্ঘাতিক কঠিন ক্যাম্প করে ফিরে আসছে অথচ ওদের প্রত্যেকের মনে ফূর্তি দেখলে আপনি অবাক হয়ে যাবেন। পাহাড়ের উচ্চতায় সুস্থ থাকার মূল উপায় হল নিজেকে ব্যস্ত রাখা। চটপটে রাখা। কিছু না কিছু করা। আমিও তাই বসে বসে মাথা ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে বৌদির খোঁজ করতে লাগলাম। আমাদের দলের সবাই কিছু না কিছু করছে। কেউ প্রেমের জমি শক্ত করছে। কেউ প্রেমকে ছেড়ে দিয়ে দেখছে  তা ভাটিতে ফিরে আসে নাকি উজানে বয়ে যায়। কেউ নতুন আচমকা প্রেমের অভিঘাতে এতই দিশেহারা সে কিছুই বুঝতে পারছে না। সেও হয়ত এক শ্যামস্নিগ্ধ মরণের আকাঙ্ক্ষায় যমুনার জলে ঝাপ দেবার কথা ভাবছিল। দিবিয়া বসে লিখছে ওর ভ্রমণ বিবরণী। সুন্দর এক বাঁধানো খাতা। ঝরঝর করে ইংরিজিতে লিখে চলেছে। পড়ার খুব ইচ্ছে ছিল। চাইতে লজ্জা হল। ওর ইচ্ছে এগুলো ও একদিন ব্লগে লিখবে। হয়ত বইও করবে একদিন। সঞ্জনা আর আশিস দাবা খেলছে। দুজনেই পাকা খেলোয়াড়। খেলা চলছে ঘণ্টার পর ঘন্টা। কেউ খেলছে ইন্ডোর গেমস। কেউ গানের লড়াই।

  লাঞ্চে খিচুড়ি আর পাপড়। আহা! আর কি চাই। বিকেলে বদ্রি আর ভাবিয়ার বিয়েবার্ষিকীর জন্য ওর শালি নাবিয়া(নাব্য) চানাচুর দিয়ে চাট বানিয়ে খাওয়ালো সবাইকে। লোভীর মত বারবার চেয়ে খেলাম। আজ শাশ্বত কথা বলে কাঠের রেস্ট হাউসের ভেতর ঘরটা পাঁচজনের জন্য বুক করেছে। আমাকে বলায় না করলাম না। একটু গরমে থাকব। একটু ভালো ঘুমোব, বড় লোভ হল।

  রাতের মেনু ভাত, রুটি, বাইগনের তরকারি। শরীর সারাদিনের বিশ্রামে একদম তরতাজা হয়ে গেছে। কোথায় উড়ে গেছে ক্লান্তি, অবসন্নতা। পাশেই বৌদির পরিবার তাদের স্পেশাল চেয়ার-টেবিলে খেতে বসেছে। মোমবাতি জ্বলছে। এদিকে আমরা প্রায়ান্ধকার এলাকায় বসে খাচ্ছি। ওর ফোলাফোলা গালে হলুদ মোমের আলো। দেখাচ্ছে রানি ফ্রাসোঁয়া মারী আতোঁয়ানেতের মত। এতক্ষণ লজ্জাহীন তাকিয়ে আছি। হায়, কেউ তো একবার ফিরে চায়! নাকি, সে যে আমাকে দেখেছে তা বুঝলাম আমাকে লক্ষ্য করছে না বলেই। কে জানে, এই বুড়ো বয়সে ঘাড়ে পাকা রোঁ গজালে কী হবে মনের বয়স তো আমার সেই অমলকান্তি। তাই বুঝি না, রাতের সব তারাই দিনের আলোর গভীরে লুকিয়ে আছে কিনা।

  এই দেখুন তারার কথা বলতেই মনে এল আজ রাতে তারার ছবি তুলতে বাইরে যাবই যাব। জোৎস্নারাতে যাবই যাব বনে। কাঠের ঘরে সবাই যখন স্লিপিং ব্যাগের ভেতরে অন্বয়ের ট্রাইপড নিয়ে বাইরে বেরিয়ে এলাম। আকাশে আধেলা খোয়াখোয়া চাঁদ। আকাশ খুলে গেছে। অনন্ত নক্ষত্রবীথি নির্জনে শিকারে বেরিয়েছে। আমার একটু দূরে পথে সেই বিতর্কিত যুগলের মধ্যে এই প্রথম উত্তপ্ত বাক্যালাপ চলছে ঠান্ডায়, অন্ধকারে। যুবকটি আর অপেক্ষা করতে চায় না। সেই চিরন্তন প্রেমের পুরুষালি ক্লাইম্যাক্স। আজই আজই! অন্যজন বলছে ধীরে রজনী ধীরে। আমার আরেকটু সময় চাই। আমি সরে এলাম। একটু উঁচুতে উঠে জোংরির দিকে ক্যামেরা তাক করলাম।

  কী ছবি হল জানি না। গ্লাভস থেকে হাত বের করলে মনে হচ্ছে জমে যাবে। শাটার টিপতেও কষ্ট। দেখি পাশে স্বপ্না এসে দাঁড়িয়েছে। ও ব্যাঙ্গালোরের রানার ক্লাবের মেম্বার। ডক্টরসাবের ছবি দেখতে উৎসাহী। ওকে কিছুক্ষণ বোঝালাম লং এক্সপোজার ফটোগ্রাফি নিয়ে। অন্তত আমি যা জানি। কিচেন টেন্টের ছেলেরা টর্চ নিয়ে দৌড়োদৌড়ি করছে। ওদের বাসন মাজার কাজ শেষ। এবার সামান্য পান করে ঘুম। টর্চের আলো বন্ধ হয়ে গেলে শাটার মারলাম। ২৫ সেকেন্ড এক্সপোজার। ১৬০০ আই এস ও। আকাশের দিকে চাইলাম। অনেকে গোয়েচালায় এসে তারাখসার জোয়ার দেখতে পেয়েছে।

  আমি কী আর অত ভাগ্যবান যে সেই মহাজগতিক আত্মহত্যা দেখতে পাব? তবু স্মৃতির সঞ্চয় যা হল তাই বা কম কী? যদি চাঁদের আলো একটু কম হত তবে মিল্কি ওয়ে আরো স্পষ্ট হয়ে উঠত। তা তো আর হবার নয়। দেখলাম ছবিতে মিল্কি ওয়ের মাঝ দিয়ে জোংরির টপ উঁকি দিচ্ছে।  

থানসিং

নভেম্বর ১১, ১২

  ব্রেকফাস্ট সেরে ভোর সাড়ে আটটায় আমরা থানসিং-এর  দিকে রওনা হলাম। থানসিং-এর উচ্চতা ১২,৯০০ ফুট। প্রায় জোংরির কাছাকাছি। যেতে হবে আট কিমি রাস্তা। রাহুল বলল, রাস্তা খুবই সহজ। চার কি পাঁচ ঘন্টার বেশি সময় লাগার কথা নয়। আমাদের মনে দেদার খুশি। যাই হোক আজ অন্তত ঝামেলা নেই। গোয়েচালার দিনের জন্য শক্তি জমিয়ে রাখা যাবে।

  শুরুতেই মিনিট কুড়ি চড়াই ভেঙে ওপরে উঠে নীচে জোংরিকে দেখলাম বিরাট বড় ক্যানভাসে একজন শিল্পী সবার শেষে অবলীলা ও অবহেলায় যে ছোট্ট একটা কুঁড়ে আঁকেন বা নিজের সইটি করেন- তেমন দেখাচ্ছে। এরপর আমরা অনেকটা পথ প্রায় সমতল ঢেউয়ের মত রাস্তা দিয়ে হেঁটে চললাম। আমি গোয়েচালা যেতে গিয়ে যত রাস্তা হেঁটেছি এই পথটির সৌন্দর্যের সাথে অন্য পথের কোনো তুলনাই হয় না। মাঝে মাঝে রডোর বন আর ধুসর বাদামি ঘাসের জমায়েত। অনেক ছোট ছোট নদী। যাদের অধিকাংশের জল রাতের ঠান্ডায় জমে বরফ হয়ে গেছে। পেছল পাথরের ওপর তাই সাবধানে পা ফেলতে হয়।

  অনেকটা চলার পরে আমরা একটা বেশ বড় বুগিয়াল অতিক্রম করে বিরাট কিছু পাহাড়ের চূড়ার একদম বুকের কাছে এসে দাঁড়িয়ে পড়লাম। সত্যিকারের বুগিয়াল বলতে যা বোঝায়, ঘাসে মোড়া উঁচু পাহাড়ের মাঠ যা কিনা বরফে ঢাকা সাদা পর্বতচূড়ার কোলে লেগে থাকে, এই পথের মেঠো পাহাড়ি ভূখন্ড অনেকটা তেমনই। তা হয়ত রূপকুন্ড যাবার পথের বেদিনী বা আলি বুগিয়ালের মত অত বিস্তৃত নয়। তবে এই ছোট বুগিয়ালের একটি বাড়তি পাওনা হল এটির মাথায় এসে দাঁড়ালে যদি আবহাওয়া ভালো থাকে পৃথিবীর তৃতীয় উচ্চতম শৃঙ্গের ম্যাসিফ আপনি ঝকঝকে দেখতে পাবেন। মনে হবে যেন চাইলেই তাকে ছুঁতে পারবেন। আর আমি তো আগেই বলেছি, আবহাওয়া আমাদের সঙ্গেই চলছে।

বুগিয়াল।

  তবে একে তো বুগিয়ালটা অনেক উঁচুতে তার ওপরে অত বরফে ঢাকা পাহাড়ের হাওয়া তাই বেশিক্ষণ সেখানে থাকা মুশকিল। রোদ অপরিমিত ও সুরেলা হলেও সেই হাড়কাঁপানো ঠান্ডায় ঠকঠকানি শুরু হয়ে যায়। আমরা সেই সুন্দর উঁচু জমিতে বসে অনেক ছবি তুললাম। জোংরিতে একদিন বিশ্রাম পেয়ে সবাইকে খুব খুশিখুশি তরতাজা দেখাচ্ছিল। আমাদের গোটা দলটাই যেন গোয়েচালা সামিট করার জন্য মুখিয়ে ছিল। আর সবার ওপরে দলের গড় বয়স যেহেতু সাতাশ-আটাশ তাই তাদের মধ্যে উদ্দীপনারও কোনো শেষ ছিল না। ছবিগুলোর দিকে তাকালে সেই ঝকমকে ভাবটাই যেন দেখতে পাচ্ছিলাম।

  কাঞ্চনজঙ্ঘা ছাড়াও সেখানে পান্ডিম, তেঞ্জিং খা, কাব্রু আর মাউন্ট নার্সিং কে দেখা যাচ্ছিল। আরো ছবি তোলার ইচ্ছে ছিল। রাহুল যাবার জন্য তাড়া দিচ্ছিল বারবার। তাই সবাই পিঠে ব্যাগ নিয়ে এগোনোর জন্য তৈরি হলাম। শুরু হল নীচে নামা। নামা তো নামাই। নামাকে যদি ‘অবতরণ’ বলে সম্মানিত করার চেষ্টা করা হয় তবে এই ‘অবতরণ’ সম্মানিত হতে পারে কেবল তার প্রায় সত্তর ডিগ্রি খাড়াইয়ে বিপুল উচ্চতা থেকে পাতাল প্রবেশের কারণে। সেই রাস্তায় দাঁড়াবার উপায় নেই। কারণ আপনি দাঁড়িয়ে গেলে পেছনের জন আটকে পড়বে। সে আটকালে তার পেছনের জন। তাই আমরা একটানা নামতে শুরু করলাম। রাস্তাও এত খাড়া যে একটু ভুল হলেই পতন অনিবার্য। চোট লাগা তো খুবই স্বাভাবিক। আমাদের দলের কয়েকজনের পায়ে তো ভালোই চোট লাগল। আশ্রয় বলে এক ব্যাঙ্গালোরের ছেলে পায়ে খুবই চোট পায়। ছেলেটি এত নম্র ও ভদ্র, স্মিতমুখ, মৃদুবাক যে ওকে আমার অনেকদিন মনে থাকবে। ও তারপর কয়েকদিন আমার সঙ্গে রাখা পেইন কিলার খেয়ে কোনো মতে গোয়েচালা শেষ করতে পেরেছিল।

কাঞ্চনজঙ্ঘা ম্যাসিফ।

  খাড়াই রাস্তার ওপর বড় ছোট পাথর আর ঝুরো মাটি। সবগুলোই হড়কানোর জন্য আদর্শ। মজার কথা হল নামার সময় আপনি মাঝে মাঝেই দেখবেন ওই তো থানসিং। মনে হবে এই তো দেখা যাচ্ছে। নেমে গেলে আর তো একটু পথ। আগেই বলেছি পাহাড়ে এলে আমাদের দৃষ্টি এত স্কিউড হয়ে যায় যে কখনও আপনার মনে হবে মানুষ শুধু মরুভূমিতেই মরীচিকা দেখে না। পাহাড়েও বিলক্ষণ দেখে। এর পরে আমরা হাড়ে হাড়ে বুঝেছিলাম এই ধারণা কতটা সত্যি।

  প্রায় দেড়ঘন্টা একটানা নেমে আমরা কোকচুরাং-এ পৌঁছলাম। সেখানে পৌঁছে মনে হল সবাই যে বলে কষ্টের পর উল্লাস থাকে আর পথশ্রমের পর উষ্ণ সরাইখানা, কোকচুরাং ঠিক তেমন একটা বিরতি। জায়গাটা এত সুন্দর যে কী বলব। সেখানে ক্যাম্পিং-এর জায়গা কম বলে হয়ত সবাই ক্যাম্পিং করায় না। আর আমাদের চব্বিশ জনকে নিয়ে তো ভাবারই কোনো অবকাশ নেই। তবে যারা সেখানে ক্যাম্পিং করে তারা নিশ্চই এক স্বর্গীয় অনুভূতির স্মৃতি সঙ্গে নিয়ে ফিরে আসেন।

  একটি ফরেস্ট হাট আছে। দেখে ভুতুড়ে বলে মনে হবে আপনার। কেমন যেন পরিত্যক্ত। রাহুল বলছিল ওই ফরেস্ট হাট নাকি হন্টেড। রাতের বেলায় সেখানে অপদেবতার উপদ্রব হয়। শুনেই তো আমার থাকার ইচ্ছে চোদ্দগুণ বেড়ে গেল। পাশেই প্রেকছু নদীর সুতীব্র ছলছলানি, বাতাসের শন্‌শনানি, চাঁদনী রাতের রিন্‌রিন তার সাথে তেনাদের আগমন। জীবনে আর কী চাইবার থাকে? কিন্তু তা তো আর হল না! প্রেকছু নদীর একটি ছোট শাখা জলধারা কুঁড়ের পাশ দিয়েই বয়ে চলেছে। বরফশীতল তার জল। বোতলে ভরে গলায় ঢালতে সত্যিই প্রাণ জুড়িয়ে গেল। জুতো খুলে পা দুটোকে অনেকদিন বাদে ভালো করে ধুয়ে নিলাম। হপ্তাখানেক স্নানের বালাই নেই। মাথায় জল দিয়ে ধুয়ে নিলাম। পা যদিও বরফশীতল জলে বেশিক্ষণ ডুবিয়ে রাখা যায় না। তবু সেই প্রবহমানতা আপনি ভেতরে ভেতরে অনুভব করতে পারবেন। এসবই তো স্মৃতির সঞ্চয়।

ভূতুড়ে রেস্ট হাউস।

  মূল প্রেকছু নদী প্রচন্ড খরস্রোতা। তার পারে বড় বড় পাথর। পেছনে দেখা যাচ্ছে পান্ডিম। অন্য দলের এক গাইড মোবাইলে ছবি তুলে দিল। এই দলটিও বাঙালি। এরা অশোকনগরের। এরা নাকি গোয়েচালা করে আরো কোন নতুন রাস্তা দিয়ে ইওকসাম ছাড়িয়ে এগিয়ে কোথায় উঠবে। ওরা বলল এবছর সে পথে আর কেউ যায় নি। নদীর পার দিয়ে বড় বড় পাথর ও একটি ছোট জঙ্গল পার হয়ে একটি কাঠের সেতু পার করে আমরা নদীর অন্য পারে চলে এলাম। সেই সেতুর ওপরে দাঁড়িয়ে ছবি তোলার লোভ কারোর পক্ষেই সংবরণ করা সম্ভব নয়।

  সেতু পার হয়ে এক অগভীর অরণ্যের মধ্যে দিয়ে অনেকটা পথ চলে তারপর বিপজ্জনক ধ্বসপ্রবণ এক বিরাট পাথরের পথ অতিক্রম করে যখন আমাদের বিরক্তি আর ক্লান্তি বাড়তে শুরু করেছে তখনই দেখলাম দূরে থানসিং-এর বিরাট উন্মুক্ত প্রান্তর দেখা যাচ্ছে। তার এক ধারে মাথা উঁচু করে দাঁড়িয়ে আছে বিরাট পান্ডিমের চূড়া। আসার পথে বেশ কিছুক্ষণ অনেকগুলো প্লেইন মাউন্টেন ফিঞ্চদের সাথে সময় কাটালাম। তারা দূর থেকে একেবারে আমার পায়ের কাছে চলে এল। ভয়ডর নেই। শাশ্বত আগেই এখানেও ফরেস্ট হাট বুক করে রেখেছিল। তাই সেখানেই উঠলাম। তবে মনে হল না এলেই ভালো হত। ওপরে টিনের চাল। চারিদিকে পাথরের দেয়াল। তাদের মধ্যে মাঝে মাঝেই ফাঁকা। তা দিয়ে রাতে যা হাওয়া এসেছিল তা আটকাতে আমরা রাতে আমাদের রাকস্যাক সেখানে চাপা দিয়ে রেখেছিলাম।

  দুপুরের লাঞ্চে ছিল সেই পুরি আর আলুর ঝোল। আহা! কি যে স্বাদ তার কী বলব। জোংরিতেও ঠান্ডা যথেষ্ট ছিল কিন্তু থানসিং-এ চারপাশে এত ফাঁকা আর পান্ডিমের ঠিক গোড়ায় হবার জন্য সেখানে সারাদিন ধরেই ঠান্ডার প্রকোপ ভয়ঙ্কর বেশি। দিনের বেলাতেও গায়ে তিনটে লেয়ার জড়িয়ে রাখতে হচ্ছে। কাল সকালে আমাদের লামুনে যাবার কথা ছিল। রাহুল বলল লামুনেতে এত প্রচন্ড হাওয়া চলছে আর এত ঠান্ডা পড়ে গেছে সেখানে যে সেখানে না থেকে কাল বরং থানসিং-এ থেকে যাওয়াই ভালো। কাল রাতে আমরা যখন গোয়েচালা সামিটের জন্য বের হব তখন আমাদের দুই কিমি পথ বেশি চলে লামুনে হয়ে যেতে হবে। এতে আমাদের একটু আগে বেরোতে হবে। আর লামুনেতে নাকি ঘোড়াদের খাবার ঘাস বেশি পাওয়া যায় না। আমাদের ২৪ জনের দল। সঙ্গে অনেক পনি। তাই ক্যাম্প করার অসুবিধে। আমার যদিও সিদ্ধান্তটা পছন্দ হল না, তবু সবাই রাজি আছে বলে না বললাম না।

  রাতে খাবার পর আমি আর অন্বয় ওর ট্রাইপড নিয়ে রাতের ছবি তুলতে বাইরে এলাম। ওইসময়ই আমি এই ট্রেকের আমার সবচেয়ে প্রিয় ছবিটা তুললাম। রাতের আলোয় পান্ডিমের বরফঢাকা চূড়া। টেন্টগুলোতে আলো জ্বলছে। বাইরে প্রবল ঠান্ডা। তবু ছবি তুলে মনটা ভরে গেল। অন্বয় সারা ট্রেকে অনেক কষ্ট করে এই ট্রাইপডটা বয়ে এনেছে। ও না আনলে আমার এই ছবি তোলাই হত না। এই ছবির তাই সবচেয়ে বড় কৃতিত্ব ওরই। ঘরে আমি আজহার, দীপাঞ্জনা, শাশ্বত আর রাচেত শুয়েছি। স্লিপিং ব্যাগের নীচে লাইনার আছে। নিজে পাঁচটা লেয়ার পরে শুয়েছি। তাও ঠাণ্ডায় ঘুমোতে পারছি না। যা হোক কাল সকালে হাঁটা নেই। দেরি করে বেরোলেও হবে। এটাই যা সান্ত্বনা।

রাতের থানসিং।

  থানসিং-এর পাশ দিয়ে বয়ে গেছে ছোট এক জলধারা। মনে হল নদী থেকে এরাই মাটি কেটে ওটিকে ক্যাম্পের পাশ দিয়ে নিয়ে এসেছে। একটু দূরে মাঠের পাশ দিয়ে বয়ে চলেছে প্রবল নদী প্রেকছু। বিস্তীর্ণ মাঠ, নদীর এপার-ওপার নিয়ে সমানে স্নো পিজিওনেরা উড়ে চলেছে। প্রেকছুর পার দিয়ে ওপরে উঠে গেছে কালা পান্ডিমের চূড়া। এর গায়ে একটুও বরফ জমে না। খাড়াই ঢাল। কালো চুনাপাথরের দেয়াল। তাই এমন নাম। এও যেন সাদা পান্ডিমের অন্য ধারে কৃষ্ণতাজের মত জেগে থাকতে চায়।

  সময় কাটছে না দিনের বেলায়। নদীর পারে একদম একলা চুপ করে বসে জুতো-মোজা খুলে কিছুক্ষণ ঠায় ধ্যানে বসে থাকলাম। কেউ নেই ধারেকাছে। শুধু নদীর তীব্র শব্দ। অথচ সেই তীব্র একটানা মনোটোন যেন আমার মনোসংযোগ নষ্ট করার বদলে কিছুক্ষণের মধ্যেই আমাকে চারপাশের জগত থেকে সম্পূর্ণ বিচ্ছিন্ন করে দিল। পিঠের ওপর রোদ এসে পড়েছে। সেই একটানা কলতান আমাকে কিছুক্ষণের জন্য আমার বর্তমান ও অতীতকে যেন সম্পূর্ণ বিস্মৃত করে দিল। মনে হল এই বিরাট পর্বতমালা, এই ভয়ঙ্কর সুন্দর নদী, এই অনধিগম্য উপত্যকা, এই শীতল বরফঢাকা রাত এরা এত বিপুল এত তীব্র এতই অমিত ক্ষমতার আধার যে এদের পাশে এসে নিজেকে হাস্যকর রকমের ছোট বলে মনে হয়। মনে হয় আমার সব অহমিকা, সব অস্মিতা, সব আমিত্ব এরা যেন নিঃশব্দ শ্লেষে অস্বীকার করে চলেছে।

  আমাদের লিলিপুট মানুষদের ঘাড় গুঁজে থাকায়, একে অপরের অসূয়াকলোনির ক্ষুদ্রতায় আমরা বাইরের জগতের প্রতি আশ্চর্য রমকমের অজ্ঞতার জন্যই হয়ত নিজেদের নিয়ে এই বিরাট স্যাটায়ারে দিনরাত বিরামহীনভাবে অভিনয় করে যেতে পারি। যদি আমাদের জীবনের সাথে এই বিপুলতাকে একটুও জড়িয়ে নিই তবে হয়ত আমাদের দুর্দশা দেখে আমাদের নিজেদেরই করুণা হবে। তবে এই বিপুলতায় নিজেকে হারিয়ে ফেলার ভয় আছে। এই অ্যালিনিয়েশন সংসারের পক্ষে মঙ্গলের কিনা তাই নিয়েও প্রশ্ন উঠতেই পারে। পাহাড়ে এলে একটা জিনিস আমি বারবার বুঝি, পাহাড় যাকে একবার ডেকে নেয় সে কেন আর নিচের পৃথিবীতে ফিরতে পারে না। কেন যুগ যুগ ধরে সংসারত্যাগী গিরিগুহায় তপস্যারত সন্তরা ঘরে ফেরার কথা ভাবতেই পারেন না।

  ক্যাম্পে ফিরে এসে দেখলাম আজ রাতে সামিট করে দুটো দল ফিরে এসেছে। তাদের মুখে গোয়েচালার সৌন্দর্য ও পথের কষ্টের কথা শুনে মনে হচ্ছিল আমরা পারব তো? আমি পারব তো? একটি নেপালি মেয়ে কাংড়ি দিয়ে খোলা চুল আঁচড়ে রোদে পাথরের ওপর বসে আছে। লম্বা চুলটিকে সামনে এনে ফেলে রেখেছে। পরনে সাদা টাইট টি শার্ট আর ততোধিক টাইট ট্রেক প্যান্ট। সে বলছিল তাদের বেরোতে দেরি হয়ে গেছিল। যদিও এই পাঁচ কিমি পথ মাত্র তিন ঘন্টায় হেঁটে গিয়ে তারা পাঁচটা চল্লিশ মিনিটে সূর্যোদয় দেখতে পেয়েছে। সে বলল আমরা যেন আগে থাকতে বেরোই। যুবতীটি তার চারপাশে শ্রোতা বেড়ে যাওয়ায় চুল নিয়ে এমনভাবে খেলছিল, তার দুটো পান্ডিমের চূড়াকে চুলটি দিয়ে এমনভাবে ঝালরদোলা আদর করছিল যে আমার মন বারবার সেই উপত্যকায় চলে যাচ্ছিল। এই সবে ঘন্টাখানেক ধ্যান করে এলাম। আমার মনে তবু এত পাপ! বড় পাপ হে! আসলে অনেকদিন বাড়ির বাইরে তো! একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে প্রায়ান্ধকার ডিনার রুমে ঢুকলাম। সেখানে অন্বয় আর আশিস দাবা খেলছে। সবাই দেখছে।

  সবচেয়ে মন দিয়ে দেখছে সঞ্জনা। আশ্চর্য মেয়ে। কোথাও নাকি থিতু হয় না। ২৮ বছর বয়েস। এখন মুম্বইতে আছে। খুব বেশি হলে চল্লিশ কেজি ওজন। পাঁচ ফুট উচ্চতা। অস্ট্রেলিয়ার পাঁচটি সামিট করে এসেছে। এখানে স্টোক কাংরি, এভারেস্ট বেস ক্যাম্প করে এসেছে কয়েক বছর আগে। অবলীলায় হেঁটে যায়। যে পিছিয়ে পড়ে তার সঙ্গে সঙ্গে চলতে থাকে। সকালে ছেঁড়া জুতোয় ফেভিকল স্যুফিক্স লাগিয়ে আবার হাঁটতে শুরু করে। ওর সাথে ইংরিজিতে কথা বলতে বলতে আমার নিজের অ্যাক্সেন্ট নিয়ে লজ্জা করে। তবু মেয়েটির সাথে কথা বলে মজা আছে। প্রত্যয় বাড়ে। মনে হয় ও যদি এত কিছু পারে তবে আমি এটুকু পারব না?

  রাতে স্যুপ হট অ্যান্ড সার। প্রচুর আদা আর রসুন। শরীর গরম হয়ে গেল। রাতে ডিমের ঝোল আর ভাত। আহা! কতদিন পরে ডিমের ঝোল। শুধু যে বাড়ির কথা যে মনে এল তা নয় মনটাও উৎফুল্ল হয়ে উঠল। ডিনার তাড়াতাড়ি হল। আজ রাতে আমরা সাড়ে বারোটায় বের হব। একদম কাঁটায় কাঁটায়। যার দেরি হবে সে থেকে যাবে। ঘন্টা চারেক ঘুমোবার চেষ্টা করতে হবে। যেভাবেই হোক। তবে শরীর মন খুব তরতাজা লাগছে। মনে হচ্ছে কাল হয়ে যাবে। কাল সূর্যোদয় কাঞ্চনজঙ্ঘার পায়ের তলায় দাঁড়িয়েই দেখব।   

গোয়েচালা সামিট ও ইওকসামে নেমে আসা।

নভেম্বর ১২, ১৩, ১৪

  সত্যিই কি গোয়েচালার ভিউ পয়েন্ট ওয়ান অব্দি যাওয়াটাকে আদৌ সামিট বলা যায়? একেবারেই না। একে সামিট বললে যেসব পর্বতারোহীরা অমানুষিক কষ্ট ও ভয়ঙ্কর বিপদ মাথায় নিয়ে পাহাড়ের চূড়ায় ওঠেন, তাদের অবমাননা করা হয়। কিন্তু চালু কথা হল, ট্রেকে সবাই এমনটাই বলে। পাঙ্গারচুলা সামিট, বুরানঘাটি সামিট, রুপিন পাস সামিট। গোয়েচালায় ভিউ পয়েন্ট ওয়ান পর্যন্ত যাওয়াকেই সবাই সামিট বলে। এতে ট্রেকারদের হাঁটাকে কিছুটা মহানতা দেবার চেষ্টা করা হয় মাত্র। কিন্তু যারা ট্রেকিং করেন না তারা সবসময় এই কথাটা মনে রাখবেন যেখানে ট্রেকিং শেষ হয় সেখান থেকে পর্বতারোহণ শুরু হয়। যেমন গোয়েচালা ‘সামিট’ হল কাঞ্চনজঙ্ঘার বেস ক্যাম্প। আগে হয়ত এখান থেকেই পৃথিবীর তৃতীয় উচ্চতম শৃঙ্গ আরোহণ করা শুরু হত। এখন তো শুনেছি নেপালের দিক থেকে আরোহণ করা হয়। আগে ভিউ পয়েন্ট তিন অব্দি নিয়ে যাওয়া হত- যা এখান থেকে বিরাট কিছু দূরে নয়। শুনেছি ওই রাস্তায় স্নো লেপার্ড দেখা যাবার পরে সংরক্ষণের কারণে ভিউ পয়েন্ট ওয়ানের পরে এখন আর নিয়ে যাওয়া হয় না।

  রাত ঠিক সাড়ে বারোটায় আমরা বের হলাম। বাইরে তখন কেমন ঠান্ডা তাকে বোঝানোর জন্য হাড়কাঁপানো বা কনকনে কোনো উপমাই যথাযথ নয়। দুটোর মধ্যে ‘কনকনে’ শব্দটাই যদিও আমার বেশি পছন্দের। প্রথমটি ইংরিজি থেকে ধার করা বলে শুধু নয়, দ্বিতীয়টির মধ্যে ধ্বন্যাত্মক ইঙ্গিতটা আমার খুব পছন্দসই। আমরা যারা গরমে থাকি আমাদের পক্ষে সেই ঠান্ডা ভীতিপ্রদ। নেপোলিয়ানের সেনাবাহিনীর মস্কো অভিযানের মত ব্যাপার খানিকটা। এও হয়ত কিছুটা বাগ্‌বিস্তার হয়ে গেল। তবু মাইনাস দশ ডিগ্রি তাপমাত্রাকে খুব একটা সহনীয় কেউ নিশ্চই বলবেন না। বোতলে গরম জল নিয়ে রওনা হলাম। যদিও লাভ কিছুই হল না। মিনিট তিরিশের মধ্যেই সেই জল বরফঠাণ্ডা হয়ে গেছিল। তবে বাঁচোয়া যে তেমন হাওয়া চলছিল না। তাই আমাদের পক্ষে ঠান্ডার মোকাবিলা করা কিছুটা সহজ হয়েছিল।

  পাঁচটা লেয়ার পরে হাঁটছি। তাও হাঁটার পরে শরীর গরম হচ্ছে না। চারিদিকে নিকষ কালো। আমরা শুধু হেড টর্চের আলোতে পথ দেখে চলেছি। আকাশে আধখানা চাঁদ। কিন্তু তার আলো কোথায় গেল কে জানে। সারা রাস্তায় পাথর আর প্রচুর ছোট বড় জলধারা। তাদের পাথরের ওপর সতর্কভাবে পা ফেলে পেরোতে হচ্ছে। কারণ জল জমে অনেকাংশেই বরফ হয়ে গেছে। মাঝেমাঝেই পা পিছলে যাচ্ছে বরফে। একে ঠান্ডা তায় চরাই। হাঁটছি আর হাঁপাচ্ছি। ঘন্টা দুই চলার পরে আমরা দু-কিমি রাস্তা অতিক্রম করে লামুনেতে এসে পৌঁছলাম। এসে বুঝলাম এখানে না থাকার সিদ্ধান্তটা খুব ভুল কিছু ছিল না। চারিদিকে ফাঁকা। ছোট্ট একটা ট্রেকার্স হাট। প্রচন্ড জোরে হাওয়া চলছে। তার সাথে পাল্লা দিয়ে ঠান্ডা। এতদূর আসার পরেই আমাদের দলের একজনের শ্বাসকষ্ট শুরু হল। সে আর যেতে না পেরে লামুনের ট্রেকার্স হাটে বিশ্রাম নেবার সিদ্ধান্ত নিল।

  আমরা এগিয়ে চললাম সমিতি লেকের দিকে। চারপাশে কিছুই দেখতে পাচ্ছি না। আকাশও পরিষ্কার হয় নি। শুধু সামনে ট্রেইল দেখে হাঁটতে লাগলাম। দলে যারা একটু পিছিয়ে পড়েছিল তাদের সামনে রেখে বাকিরা পেছনে চলছিল। উদ্দেশ্য ছিল সমিতি লেক অব্দি সবাই একসাথে যাব। তারপর সময় কমে গেলে যারা আগে যেতে পারবে তাদের আগে আগে সামিট পর্যন্ত যেতে দেওয়া হবে। সমিতি লেক পর্যন্ত আসতেই আমার অবস্থা খারাপ হয়ে গেল। শুনেছিলাম সমিতি লেকের পরের চরাই নাকি বিখ্যাত। দম বাঁচিয়ে রেখে সেই চরাইয়ে উঠতে গিয়ে অতি বড় ক্ষমতাবান লোকের অবস্থাও কাহিল হয়ে পড়ে। পাহাড়ে হাঁটতে গিয়ে আমার সবসময় মনে হয় হাঁটাটা শুধুমাত্র মানসিক ও শারীরিক ক্ষমতার ওপর নির্ভর করে না। সেই বিশেষ দিনটিতে আপনার শরীরের অবস্থা, আবহাওয়ার অবস্থা এবং পথের সাথে আপনার একাত্মতার ওপর অনেক কিছুই নির্ভর করে।  

  রাতে পথ হাঁটার একটা সুবিধে অবশ্য আছে। পথ যেহেতু চোখে দেখা যায় না, তাই কতটা হাঁটছি বা সামনে কতটা চরাই তা বোঝা যায় না। তাই মনের ওপর চাপ কম পড়ে। আর মাথার ওপরে রোদ না থাকায় শরীরে জলের ঘাটতি কম হয়। যদিও মাঝেমাঝেই গলা শুকিয়ে কাঠ হয়ে আসছে। কিছুটা জল বাঁচিয়ে রেখেছি সমিতি লেকের পরে চরম চরাইয়ের জন্য। কখন সমিতি লেক চলে এল বুঝতে পারলাম না। কারণ অন্ধকারে লেককে তো আর আলাদা করে বুঝতে পারছি না। তবে লেক যে পার হয়ে গেছে তা বুঝতে পারলাম দমফাটা চরাই শুরুর আভাস পেয়ে। এই বেগে যদি হাঁটি তবে আরো দু-ঘন্টা লাগবে গোয়েচালা আসতে। আমার প্রতিমুহূর্তে মনে হচ্ছিল অতক্ষণ হাঁটা আমার পক্ষে আর হয়ত সম্ভব নয়।

  সামনে বেশ কয়েকজন এগিয়ে গেছে। আমি নিজের শারীরিক ও মানসিক ক্ষমতার প্রায় শেষ সীমায় এসে পৌঁছেছি। ওপরে মনে হয় গোয়েচালা দেখা যাচ্ছে। আমার মনে হল ওটা যদি সামিট না হয়, রাস্তা যদি আরো মিনিট দশেকের বেশি হয় তবে আমি আর পৌঁছতে পারব না। আমি বড়জোর আর মিনিট পাঁচেক হাঁটতে পারব তার বেশি নয়। শেষে মিনিট দশেক নিজেকে নিংড়ে নিয়ে হাঁটতে হাঁটতে অবশেষে গোয়েচালা সামিটে পৌঁছলাম। আমি যেতেই সঞ্জনা আর রাহুল অভিনন্দন জানালো। দেখি তখন কাঞ্চনজঙ্ঘার ওপর প্রথম আলো এসে পড়েছে। হালকা লালচে আলো। ঘড়িতে সময় দেখলাম পাঁচটা চল্লিশ। সূর্যোদয়ের ঠিক দু-মিনিট আগে আমি সামিটে এসে পৌঁছেছি। দেখতে দেখতে কিছুক্ষণের মধ্যে প্রতিটি চূড়ায় ঊষার আলো এমন ভাবে ছড়িয়ে গেল যে দেখে মনে হবে কোনো শিল্পী যেন বেশি বেশি করে কমলা আর হলুদ রঙ পর্বতের মাথাগুলোতে ঢেলে দিয়েছেন। লোথানভাই আমাকে এক গ্লাস কফি দিলেন। আহা! ওই ঠাণ্ডায় ১৫,১০০ ফুট উচ্চতায় ভোর পাঁচটা পয়তাল্লিশ মিনিটে এক গ্লাস গরম কফি। ভাবা যায়?

কাঞ্চনজঙ্ঘায় প্রথম আলো।

  কফিটা আমাকে অনেকটা তরতাজা করে দিল। বোতল থেকে জল খেয়ে ছবি তোলায় মন দেব ভাবলাম। কিন্তু জল খাব কি, দেখি সেই বোতলের জল জমে বরফ হয়ে গেছে। বরফের কুচি মুখে দিয়ে গরম করে গলিয়ে তৃষ্ণা মেটালাম। চারিদিকে সেলফি আর গ্রুপফির ঝড় শুরু হয়ে গেল। এর মধ্যে একে একে সবাই কাহিল অবস্থায় সামিটে এসে পৌঁছেছে। আমাদের সবাইকে নিয়ে টিটিএইচ-এর ব্যানারের সাথে একটা ছবি তোলা হল। সামিটের ওপরে একটা জায়গায় পতাকা টাঙ্গানো। অশোকনগর থেকে যে দলটা এসেছিল তারা ‘ভারতমাতাকি জয়’ স্লোগান তুলে জাতীয় সঙ্গীত গাইল। তাদের মধ্যে অত্যধিক উৎসাহী একজন খালিগায়ে বারমুডা পরে ছবি তুলল। তার হয়ত মানত ছিল গোয়েচালার সামিটে গিয়ে এই অমানুষিক কাজটা করতে পারলে তার বান্ধবী তাকে ইয়েস করে দেবে। আরো কিছুর মানত হয়ত ছিল। আমরা সবাই এসে যাওয়ায় সেসব আর করতে পারল না।

  ক্যামেরা বের করে ছবি তুলতে গেলে হাত সেকেন্ডের মধ্যে লাল হয়ে যাচ্ছে এত ঠান্ডার কামড়। পাথরগুলো এত নড়বড়ে যে তাতে ভালোভাবে দাঁড়ানোও মুশকিল। দূরে দেখা যাচ্ছে অনেক নীচে মেঘ। তাতে ঊষার আলোর বহুরূপী খেলা চলছে। আমরা মেঘের মুলুক ছাড়িয়ে অনেকটাই ওপরে চলে এসেছি। আমার সামনে কাঞ্চনজঙ্ঘা, কাব্রু নর্থ সাউথ আর কাব্রু ডোম, তেঞ্জিং খা, জপুনো, সিনভু আর গোয়েচার চূড়া। গোয়েচা লা থেকে কাঞ্চনজঙ্ঘার কেবল সাউথ ফেসটাই দেখা যায়। আমার পেছনে পান্ডিমের কালো বরফবর্জিত দেওয়াল। সাদা পিঠটা পড়েছে উল্টোদিকে। নিচে বিরাট বড় হিমবাহ। প্রায় পুরোটাই মোরেন দিয়ে ঢাকা। কাঞ্চনজঙ্ঘাকে এত কাছ থেকে দেখা যাচ্ছে যে তার উচ্চতা নিয়ে মনের মধ্যে সংশয় দেখা দিল। ওটাই কাঞ্চনজঙ্ঘা তো? অতটুকু উচ্চতা তো একদিনেই চড়ে ফেলা যায়! বুঝে দেখুন পাহাড়ের জ্যামিতি আমাদের দৃষ্টিতে কতটা বিভ্রম সৃষ্টি করতে পারে। তবে গোয়েচালা সামিটে বরফের পরিমাণ খুবই কম। আবহাওয়া খুব ভালো বলে বা কিছুদিন একেবারেই বৃষ্টি না হবার জন্য বা হয়ত উষ্ণায়নের জন্য সামিটে বরফ এত কম। রাহুল তো তেমনই বলছিল।

ঈশ্বরের কাছেই।

  এখানে বেশিক্ষণ থাকায় অসুবিধে আছে। গত পাঁচ ঘন্টায় উঠেছি ২০০০ ফুট। তাও এই ঠান্ডায়। নামতে হবে এখনও অনেক রাস্তা। এখানে শরীর খারাপ হলে কারোর কাঁধ ছাড়া আর অন্য উপায় নেই। তাই রাহুল তাড়া লাগাচ্ছিল। আমরা মিনিট কুড়ি সময় কাটিয়ে নামতে শুরু করলাম। নামার সময়েই দেখি সামিটে একটা আলপাইন অ্যাকসেন্টর। একদম সামনে ঠায় বসে। বার্ডিং লেন্স নিই নি। ১৮-১০৫ দিয়েই ছবি তুললাম। আলো খুব কম। ছবি তেমন জমল না। তবু এই ১৫,০০০ ফুটে হেঁটে এসে আমি জীবনে এই প্রথমবার কোনো পাখির ছবি তুললাম। এটা আমার একটা স্মরণীয় অভিজ্ঞতা হয়ে থাকবে।

আলপাইন অ্যাক্সেন্টর।

  বেশ দ্রুতই নেমে আসছিলাম ওপর থেকে। তবু মনে হচ্ছিল যেন রাস্তা শেষ হচ্ছে না। বেশ কিছুটা নামার পর দেখলাম দূরে সমিতি লেক দেখা যাচ্ছে। চারিদিকে পাহাড় ঘেরা গ্লেসিয়াল লেক। এবার গোয়েচালায় এসে দেখলাম কিভাবে একটা গ্লেসিয়াল লেকের ও সেই লেক থেকে নদীর সৃষ্টি হয়। খুব ছোট এক জলধারা গোয়েচালার কাছের হিমবাহ থেকে নীচে বয়ে এসে এই লেকের সৃষ্টি করেছে। তারপর সেই শান্ত লেকের জল নিচে বয়ে কিছুদূর গিয়েই সেই ভয়ঙ্কর শক্তিশালী প্রেকছু নদীর সৃষ্টি করেছে। ওই শান্ত লেকের ওই পরিমাণ জল থেকে যে সেই ভয়ঙ্কর নদীটির সৃষ্টি হতে পারে তা নিজের চোখে না দেখলে বিশ্বাস করা কঠিন।

  অনেক নীচে নেমে আমরা সমিতি লেকের পারে এসে বসলাম। সবে তখন সূর্যের আলো সমিতি লেকের ওপরে পড়েছে। পান্নার মত সবজে নীল রঙের জল সেই লেকের। তাতে পান্ডিমের ছায়া পড়ে। অনেকের অনেক দুর্দান্ত ছবি আছে এই লেকের। কিন্তু সারাদিনের অবসন্নতায় আমার আর ওপরে গিয়ে উপযুক্ত স্থান নির্বাচন করে ছবি তোলার উৎসাহ ছিল না। এখন সেটা ভাবলে আপসোস হয় কিন্তু সেই সময়ের পরিপ্রেক্ষিতে, সেই ঠান্ডায় টানা সাত ঘন্টা হাঁটার পরে এই অবসাদ অন্তত আমার মত বয়সে এসে অস্বাভাবিক নয়। আমরা সকলে প্যাকড লাঞ্চ খেলাম। ডিম সেদ্ধটা খুব তাড়িয়ে তাড়িয়ে খাওয়া হল। অন্যরা বসে ছিল কিছুক্ষণ। আমি নীলেশ আর স্বপ্না নিচের দিকে রওনা দিলাম। হাঁটছি তো হাঁটছিই। পথের আর কোনো শেষ নেই। ভেবে অবাক লাগছে এতখানি পথ এই কিছুক্ষণ আগেই ঘন অন্ধকারে পার হয়েছিলাম! এটা ভাবলে যতটা অবাক হচ্ছিলাম ততটা আশ্বস্তও লাগছিল।

সমিতি লেক।

  লামুনে আসার আগে দেখলাম তিনটি ব্লু শিপ মাঠে ঘাস খাচ্ছে। জুম লেন্স সঙ্গে নেই। ১৮-১০৫ দিয়েই খুব কাছে গিয়ে ছবি তুললাম। সঙ্গে বাচ্চা ছিল। তবু অনেকটা কাছে যেতে দিল। দূর থেকে থানসিং দেখতে পাচ্ছি। দেখতেই পাচ্ছি কেবল তা কাছে আর আসছি না। কত জলধারা পার হলাম। কত পাথরের গুঁতো ধাক্কা হোঁচট খেয়ে রওনা হবার প্রায় ন-ঘন্টা পরে থানসিং পৌঁছলাম। দীর্ঘদিনের প্রতীক্ষার অবসান হল। কতদিন ধরে ভেবে আসছি গোয়েচালা করব। সে আর হচ্ছিল না। এবার বন্ধুদের থেকে সাড়া না পেয়েও একাই জোর করে যে এসেছিলাম তাই একে করতে পারলাম। সবার প্রতীক্ষায় বসে থাকলে আবার কবে হত কে জানে?

  জুতো খুলে রোদে কিছুক্ষণ পা ছড়িয়ে বসলাম। পায়ের আঙ্গুল থেকে শুরু করে কুঁচকি প্রতিটি অংশ যেন নিজের মত করে ব্যথায় টনটন করছে। তার সাথে অবসন্নতা তো আছেই। সেদিন রাতে শুয়ে ঠাণ্ডায় কাঁপতে কাঁপতে ভাবলাম যা হোক কাল সোখায় গিয়ে অন্তত আবার উষ্ণতার আমেজ পাওয়া যাবে। রাতে এলোমেলো ঘুমে স্বপ্ন দেখলাম মাটিতে একটি শিশুকন্যা বসে আছে। ভাবলাম এ কার মেয়ে? পরে দেখি আমার শালা এসে তাকে কোলে নিল। বুঝলাম হয়ে গেল। আমার শ্বশুরমশাই তিনটি কন্যারত্ন প্রসব করিয়ে একটি ছেলে পেয়েছেন। তিন কন্যাকে চারটি মেয়েকে জন্ম দিতে দেখেছেন। এবার যদি ছেলের ঘরেও মেয়ে আসে তবে বুড়ো মানুষ বড়ই মনোকষ্ট পাবেন। পরের স্বপ্নে দেখি আরেকটি মেয়ে। মাথায় কোঁকড়ানো চুল। এ কার? দেখলাম আমি গিয়ে কোলে নিলাম। সর্বনাশ করেছে। এ কী আমার মেয়ে? এই বুড়ো বয়সে আবার? মনকে সান্ত্বনা দিলাম না না এ হতেই পারে না। এ ভোরের দিকের স্বপ্ন তো। হয়ত যৌনস্বপ্ন। আসলে বুঝতেই পারছেন অনেক দিন বাড়ির বাইরে তো!

  পরের দিন সোখা নেমে আসতে গিয়ে কোকচুরাং থেকে ওরা জঙ্গলের মধ্যে দিয়ে অন্য এক রাস্তা দিয়ে আমাদের ফেদাং পর্যন্ত নিয়ে এল। সে রাস্তা অনন্ত। সে রাস্তা কিছু জায়গায় যেমন বিপজ্জনক তেমনি দীর্ঘ। বিরক্তি ও ক্লান্তিতে সেই রাস্তা পার হতে হতে আমাদের সবার আর পথের সৌন্দর্যের দিকে নজর ছিল না। কিছু কিছু জায়গায় প্রপাতের জল জমে বরফ হয়ে কেলাসাকারে নিচে ঝুলছিল। কিছু জায়গায় প্রপাত একেবারে হঠাৎ করে খাড়া নেমে গেছিল নিচে। ফেদাং-এ এসে সেদিন খুব কাছে থেকে কিছু পাখির ছবি তুললাম। বৌদির দোকানে এগ্‌ম্যাগি খেলাম। তারপর দীর্ঘ হাঁটাপথ পেরিয়ে আমাদের আগের পেরিয়ে আসা পথে আবার হেঁটে এসে সন্ধ্যের প্রায় মুখে আমরা সোখা পৌঁছলাম। সেদিন রাহুলের জন্মদিন। সোখাতে আমাদের ছোট সেলিব্রেশন হল। পরের দিন সকাল সকাল বের হয়ে চেনাপথ পার হয়ে অনেক চেনা ব্রিজ চেনা চরাই-উৎরাই পেরিয়ে ইওকসামে পৌঁছলাম। এগারো দিন স্নান করি নি। গালের দাড়ি যে আর একটিও কালো নেই এই এগারো দিনের নমোতুল্য দাড়ি দেখে সেটাই আবিষ্কার করলুম।

  রাতে কেউ মদ খেয়ে বমিটমি করল। এবারের ট্রেকের শেষদিনে আমাদের দলের কেউ না থাকায় আর মাল খেলাম না। বছরে একদিন মাল খাবার কোটাটাও বাকি পড়ে রইল। পুরনো বন্ধুরা কেউ না গেলেও নতুন অনেক বন্ধু হল। নীলাঞ্জনকে দেখলাম ও কিভাবে বিপদেআপদে সবার পাশে এসে দাঁড়ায়। নীলেশকে দেখলাম ও কিভাবে কম্যান্ডোদের মত পাহাড়ে হেঁটে যায়। ও যে স্টোক কাংরি করে এসেছে সেটা ওকে দেখলেই বোঝা যায়। আমাদের দলের সবচেয়ে রূপবান পুরুষ শাশ্বত যে কিনা ওটিটি প্ল্যাটফর্মে অনেকটাই নাম করে ফেলেছে ওর সাথে আলাপ হল। একসাথে থাকলাম। দীপু মানে দীপাঞ্জনা যে নাকি আমার বাড়ির পাশেই সোদপুরে থাকে তার সাথে অনেক গল্প হল। শিলিগুড়ির ছেলে সৌরভ বারবার আমার ছবি তুলে দিতে এগিয়ে আসছিল। ওর কথামতো একবার বন্ধুদের সাথে সিকিমের নতুন ট্রেকরুট ফোকতেধারা যাব মনে মনে সেটা ঠিক করে রাখলাম।  

  এর সাথে বাকি মেয়েরা তো ছিলই। ট্রেকে এসে নতুন নতুন মেয়েদের সাথে আলাপ হওয়াটা একটা দারুন অভিজ্ঞতা। যদিও এরা আমার হাঁটুর বয়সী তবু এরা এত অল্প বয়স থেকেই একা একা পাহাড়ে বেরিয়ে পড়েছে এটা দেখে আমার মেয়ের কথা মনে পড়ে। মনে হয় আর কদিন বাদেই আমরা দুজনে একসাথে ট্রেকে বেরোব। ওর এবার বারো হবে। অন্তত পনেরো না হলে নিয়ে আসব না। আরেকটু বড় হোক। আরেকটু শক্তপোক্ত হোক। অন্বয় আর নীলাঞ্জনের সাথে মোটামোটি কথা হল আগামিবার মে-জুন মাসে রুপিন পাস করব। আমার বন্ধুদের সাথে কথা বলে ডেটটা ঠিক করে ফেলতে হবে। বয়স বেড়ে যাচ্ছে। কঠিন ট্রেকগুলো এবার করে নিতে হবে। সহজ ট্রেকগুলো মেয়েকে নিয়ে পরে করব।

  সকালে সবার থেকে বিদায় নিয়ে গাড়িতে উঠে বসলাম। পাহাড়ি ব্রিজ, জলধারা, ম্যাগনোলিয়া ফুলের গাছ, উঁচু পাহাড়, শান্ত নির্বিবাদী জীবন, প্রচুর অর্কিড, বাড়ির গায়ে সাজানো ফুলের গাছ, বেগনি স্কোয়াশের ফুল, হে প্রচুর রডোগাছের দেশ, বিরাট বিস্তৃত অরণ্যভূমি, অবারিত শীতে কুঁকড়ে যাওয়া প্রান্তর, প্রচন্ড পুরুষ নদী, মুখ হাঁ করে দেওয়া পর্বতচূড়া, অনেক অনেক কষ্ট আর অনেক অনেক মধুর স্মৃতি নিয়ে নিচে চললাম।

  যতই পাহাড় পাহাড় করি না কেন কিছুদিন গেলেই বাড়ির জন্য, সেই ভিড় দৌড় ক্যাকোফোনির জন্য মন কেমন করে কিনা কে জানে? নাকি সেসবই অভ্যাস। স্নেহ প্রেমের মুখগুলো তো দেখতে ইচ্ছেই হয়। স্থির জানি পাহাড় এখনো আমাকে পুরোপুরি গ্রহণ করে নি। আমার এই পথচলা এখনো ভ্রমণ, প্রবজ্যা হয়ে ওঠে নি। আমার এখনো বাড়ির জন্য মন কেমন করে। গৃহের আশ্রয় ও আরামের জন্য লোভ হয়। তবু আমাকে বারবার ফিরে আসতে হবে এখানে। অপেক্ষা করতে হবে কোনো তারাভরা জোংরির রাতের জন্য যেদিন পাহাড় সত্যিই আমাকে নিজের ভেবে কাছে টেনে নেবে। 

4 thoughts on “গোয়েচালার ডায়েরি

  • December 11, 2021 at 5:23 am
    Permalink

    অসাধারণ লেখা সির, মনে হচ্ছিল নিজেই সব দেখতে পাচ্ছিলাম বা অনুভব করছিলাম ।

    Reply
  • December 11, 2021 at 5:24 am
    Permalink

    অসাধারণ লেখা sir, মনে হচ্ছিল নিজেই সব দেখতে পাচ্ছিলাম বা অনুভব করছিলাম ।

    Reply
  • December 11, 2021 at 5:25 am
    Permalink

    খুব ভালো লাগলো

    Reply
    • June 19, 2022 at 5:35 pm
      Permalink

      ধন্যবাদ আপনাকে।

      Reply

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *