দ্য অ্যালকেমিস্টঃ পাওলো কোয়েলহো।
এই বইটি লেখকের দ্বিতীয় বই। প্রকাশিত হয় ১৯৮৮ সালে। লেখক পর্তুগিজ ভাষায় মূল বইটি লেখেন। পাউলো বলেছেন তিনি নাকি মাত্র দু-সপ্তাহে বইটি লেখা শেষ করেছিলেন। তিনি আরও বলেন, মনে হয় বইটার বিষয়বস্তু যেন আমার ভেতরেই লুকিয়ে ছিল। বইটি ব্রাজিল ও লাতিন আমেরিকায় অসম্ভব জনপ্রিয় হয়। ইংরেজি অনুবাদে সারা পৃথিবীতে প্রায় ২ লক্ষ কপি বিক্রি হয়। পাউলো পরে আরও অনেক বই লিখলেও লোকে এখনও তাকে মূলত এই বইটির স্রষ্টা হিসেবেই মনে রেখেছে।
আমি বইটি পড়া শুরু করেছিলাম প্রায় বছর দশেক আগে। তারপর ভুলে গিয়ে আর পড়া হয় নি। এর মধ্যে আবার নতুন করে পড়া শুরু করে শেষ করলাম। উপন্যাসটি ছোট। পড়তে বেশি সময় লাগে না। ইংরেজি অনুবাদও খুব ঝরঝরে। বিষয়বস্তুও লঘু। তাই পড়াটা আনন্দের। শেষ করতে সময় বেশি লাগে না।
বালক সান্তিয়াগো এক আন্দালুসিও মেষপালক। সেই এই গল্পের কেন্দ্রীয় চরিত্র। সে চায় ঘুরে বেড়াতে। সারা পৃথিবীকে নিজের চোখে দেখতে। সে নিজের কাজে গর্বিত। সে ভেড়াদের চরিত্র বোঝে। তাদের গায়ের লোম ছাড়াতেও দক্ষ। সেখানেই হঠাৎ করে তার দেখা হয় এক বৃদ্ধ লোকের সাথে। তিনি নিজেকে সালেমের রাজা বলে পরিচয় দেন। তাকে বলেন মিশরে যেতে। সেখানে পিরামিডে ধনরত্ন সন্ধান করতে। তিনি আরও বলেন প্রত্যেকের উচিত নিজের ‘ব্যক্তিগত লেজেন্ড’ অনুসরণ করা। সে তখন এক জিপসির কাছে হাত দেখাতে যায়। সেও বলে সান্তিয়াগোর কপালে গুপ্তধন প্রাপ্তি লেখা আছে।
সে তখন তার ভেড়াদের বিক্রি করে টাকার জোগাড় করে আফ্রিকা যায়। সেখানে এক ঠকের পাল্লায় পড়ে নিজের সব অর্থ হারায়। তারপর কয়েক বছর এক ক্রিস্টাল বিক্রেতার দোকানে কাজ করে টাকা জমিয়ে সেই টাকায় উট কিনে পিরামিডের দিকে রওনা হয়। পথে পরিচয় হয় এক ইংরেজের সাথে। সে চলেছে অ্যালকেমিস্টের সন্ধানে যে কিনা সীসাকে সোনাতে পরিণত করতে পারে।
তারপর পথে এক মরূদ্যানে তাদের ক্যারাভান পৌঁছায়। সেখানে তার আলাপ হয় ফতেমার সাথে। তাদের প্রেম হয়। ফতেমা বলে অন্য সব মরুবালিকাদের মত সেও তার ফিরে আসা পর্যন্ত অপেক্ষা করবে। এর মধ্যে নানা ঘটনা ঘটতে থাকে। মরুভূমিতে জাতিগত যুদ্ধ শুরু হয়। এসময় তার আলাপ হয় অ্যালকেমিস্টের সাথে। তিনি তাকে পথ দেখিয়ে পিরামিডে নিয়ে যান। শেষে ঘটনা অন্য দিকে মোড় নেয়। কিন্তু সান্তিয়াগো নিজের লক্ষ্যের দিকে এগিয়ে যায় এবং গুপ্তধনের সন্ধান পায়।
সংক্ষেপে এই হল গল্প। গল্পে খুব বেশি আলংকারিকতা নেই। বাহুল্য নেই। কিছু কিছু নাটকীয় মুহূর্ত আছে। তবে সেটুকুই একটা অভিযানকে বোঝাতে ঠিক যতটুকু প্রয়োজন। উপন্যাসটি নীতিকথামূলক। সেই অর্থে এটিকে ‘ফেইবল’ বলা যেতে পারে। মূল নীতিকথা হলঃ প্রত্যেকের তার নিজের ব্যক্তিগত লেজেন্ড যার সংকেত সে নানান সূত্র থেকে পেতে পারে তাকে অনুসরণ করা উচিত। কিন্তু আমরা প্রত্যেকেই তাকে ভুলে গিয়ে বা অবিশ্বাস করে মাঝপথে তাকে অনুসরণ করা ছেড়ে দিই। তাই জীবনে সফলতা আসে না। কিন্তু মানুষ যদি তাকে সত্যি অনুসরণ করতে পারে তবে এই পৃথিবীর আধ্যাত্মিক হৃদয় তার আন্তরিক সহযোগী হয়ে ওঠে।
উপদেশমূলক উপন্যাস হিসেবে ঠিক আছে। কিন্তু আমার মনে হয়েছে সাহিত্যিকভাবে এই উপন্যাসের জমি খুব দূর্বল। শুধু ভাষাগত নয় উপস্থাপনাগত দূর্বলতাও চোখে পড়ার মত। একই লেজেন্ডের কথা বারবার বলা মাঝে মাঝেই আমার কাছে ক্লান্তিকর মনে হয়েছে। আধ্যাত্মিকতাও খুব গভীর নয়। সেই তুলনায় অলৌকিকতা প্রাধান্য পেয়েছে। ফলে একে আমার খুব উঁচু দরের আধ্যাত্মিক উপন্যাস বলেও মনে হয় নি। লেখক চেয়েছিলেন তার নতুন পাঠককে গল্প পড়াতে যারা খুব বেশি ভাববে না কিন্তু বিশ্বাস করবে। অনেকটা ভক্তিবাদের মত। প্রশ্ন করবে না, সমর্পণ করবে। খানিকটা এই ঘরানার ভাবনা।
তবে আমি অবশ্যই বলব বইটির নীতিগত তাৎপর্য আছে। পাঠক তার সমাদর করেছে। লেখক লক্ষ্মীলাভ করেছেন। ভাল, কিন্তু আমার ব্যক্তিগত পছন্দের তালিকায় আমি এই উপন্যাসকে রাখতে পারছি। যারা হালকা লেখা পছন্দ করেন। বিশ্বাসে মিলায় বস্তু… এই জাতীয় মতবাদে বিশ্বাসী- এই বই তাদের জন্য। যে খায় চিনি তারে যোগায় চিন্তামণি- বহুল প্রচলিত এই বাংলা প্রবাদের কথাই পাউলো তার সারা উপন্যাস জুড়ে বলে গেছেন।