দ্য ওল্ড ম্যান অ্যান্ড দ্য সী। আর্নেস্ট হেমিংওয়ে।
“A man can be destroyed but not defeated.”
আমি এখনও চোখ বুজলে দেখতে দেখতে পাই বৃদ্ধ মেছুড়ে সান্তিয়াগো তাঁর ছোট্ট ডিঙি নিয়ে কিউবার সমুদ্রে মাছ ধরছে। আকাশের মেঘের রং বদলে যাচ্ছে বুড়ো তবু নিশ্চিত আগামি তিনদিন বৃষ্টি হবে না। জলের রং সূর্যাস্তের সাথে সাথে পার্পল হয়ে যাচ্ছে। সকালে যখন আকাশের দিকে তাকানো যায় না, জলের দিকে তাকানো যায় না তখন ডলফিনের ঝাঁক, উড়ুক্কু মাছের ঝাঁক দলবেঁধে স্রোতের দিকে চলতে থাকবে। ডিঙি চলতে থাকলে দূরে পারের ঝাপসা পাহাড়ের রেখাও একসময় মিলিয়ে যাবে। তবু সান্তিয়াগোর কোনো ভয় নেই। যারা সমুদ্রে আসে তারা কখনও ভয় পায় না। বুড়ো চেনে আকাশ, মেঘ, সমুদ্র, মাছ তাই তার ভয় নেই। কম্পাস নেই তো কী হয়েছে, দৃষ্টি কমে এসেছে তো কী হয়েছে- এ সমুদ্র তার হাতের তালুর মত চেনা। এতে কেউ পথ হারায় না।
টানা ৮৪ দিন মাছ ধরতে গিয়ে মাছ পায় নি সান্তিয়াগো। চরম অপয়া এই অপবাদে বাচ্চা ছেলে ম্যানোলিন যে কিনা তাঁর সহকারী ও শিক্ষানবীশ ছিল, ছিল তাঁর নয়নের মণি, অন্ধের যষ্ঠি- তাঁর বাবা-মা তাকে দিয়ে দেয় অন্য জাহাজে। সঙ্গে খাবার পয়সা নেই, মাছ ধরার টোপও সীমিত, তবু সান্তিয়াগো একাই হাল না ছেড়ে পরদিন সকালে ডিঙি নিয়ে বেরিয়ে পড়ে। প্রতিটি দিনই এক নতুন দিন। অবশেষে বিরাট এক মার্লিন মাছ ধরা পড়ে তার ফাঁদে। এত বড় যে তার দৈর্ঘ্য ছাড়িয়ে যায় তার ডিঙ্গিকে। টানা তিনদিন বুড়োকে ঘোল খাইয়ে সমুদ্রে নাকানিচোবানি খাওয়ায় সেই মার্লিন। বুড়ো সারাদিন সারারাত সেই মার্লিনের সাথে তার আত্মকথন চালিয়ে যায়। চোখ ঘুমে ঢলে আসে কিন্তু ঘুমানোর উপায় নেই। লগিতে টান পড়ে পাছে মাছ সতর্ক হয়ে যায়। জল খুব কৃপণতার সাথে খেতে হয়। ডলফিন আর উড়ুক্কু মাছ মেরে তার কাঁচা মাংস খেয়ে শরীরে জোর বজায় রাখে বুড়ো। তার সাথে সাথে চলে ম্যানোলিন না থাকার জন্য আপসোস আর ‘বীর’ মার্লিনের বীরত্বের প্রশংসা। ঘাতক হয়ে ওঠে তার শিকারের প্রতি সশ্রদ্ধ।
অবশেষে তিনদিন বহু লড়াইয়ের পরে ক্ষান্তি দেয় সেই দানবাকৃতি মাছ। হার্পুন দিয়ে ঘায়েল করে রাতের বেলা তাকে ডিঙ্গির সাথে বেঁধে পারের দিকে রওনা হয় সান্তিয়াগো। রাতের কালো জলে রক্তের গন্ধে শিকারি পরজীবি হাঙ্গরের দল তার ডিঙ্গিকে আক্রমণ করে। সেই অন্ধকার রাতে বেশ কয়েকটি হাঙ্গরকে তার হার্পুন দিয়ে কাহিল করে সান্তিয়াগো। কিন্তু তার হারপুন খোয়া যায়। শেষে মাস্তুল দিয়ে লড়াই শুরু হয়। সেটিও যায়। সঙ্গে সঙ্গে হিসেব চলতে থাকে কতটা মার্লিনের মাংস আর অবশিষ্ট আছে? কতটা বিক্রির জন্য পাঠানো যাবে বাজারে? কিন্তু খালি পেটে প্রায় নিরম্বু লড়াই চালাতে চালাতে তার মাথা যায় ঘুরিয়ে, চোখে অন্ধকার ঘনিয়ে আসে, পারেরও কোনো দেখা নেই। তবুও হার মানবে না বুড়ো। একজন মানুষ ধ্বংস হতে পারে কিন্তু সে কখনও শেষ হয়ে যায় না।
অবশেষে ভোর হবার কিছু আগে দেখা যায় কিউবার সৈকত। কিন্তু ততক্ষণে ক্ষুধার্ত পরজীবি শিকারির দল তার প্রায় পুরো মার্লিনটাই সাবাড় করে দিয়েছে। শরীরে অসম্ভব ক্লান্তি, হাত হার্পুনের খোঁচায় রক্তাক্ত। বৃদ্ধ সান্তিয়াগো মাস্তুল কাঁধে করে তার বস্তির দিকে এগিয়ে যায়। ঠিক যেন প্রভু যিশু তাঁর মৃত্যুর ক্রুশকাঠ বয়ে নিয়ে চলেছে বধ্যভূমির দিকে। এক রক্তাক্ত যোদ্ধা, বয়সের ভারে ক্লান্ত অবসন্ন, দারিদ্রে জর্জরিত- তবু দুর্মর তার আশাবাদ, তীব্র তার জীবনের প্রতি প্রেম, কিছুতেই হাল ছেড়ে দেবেন না। কেঁদে চলে একমাত্র ছোঁড়া ম্যানোলিন। খবরের কাগজ নিয়ে আসে, নিয়ে আসে গরম কফি, পাশে ঠাঁয় বসে থাকে। কেউ যেন তাকে না জাগায়। চোখ দিয়ে শুধু ঝরে পড়ে স্নেহের অশ্রু। বুড়ো সান্তিয়াগো অঘোর ঘুমে ডুবে যেতে যেতে দেখেন আবার তার স্বপ্নে সিংহেরা ফিরে এসেছে।
এই নভেলা একেক বয়সে পড়ার অভিজ্ঞতা একেক রকম। ছোট বয়সে যখন পড়ি তখন অজ্ঞানতায় হেমিংওয়েকে মনে হয়েছিল ঈশ্বর। আজ মাঝবয়সে যখন পড়ছি তখন অনুভব করছি লেখকের নশ্বর হৃদয়। নভেলার প্রতিটি পাতায় সেই উৎকন্ঠা সেই আবেগ আমার বুকের ধুকপুকের সাথে মিশে যাচ্ছে। এক চরম শিল্পের বেদনা আচ্ছন্ন করছে নিজেকে। ভুলে যাচ্ছি কে ফকনার যিনি একদিন বলেছিলেন, হেমিংওয়ের কোনো সাহস নেই। অভিনব লেখার, নিজেকে আবিষ্কার করার যোগ্যতা নেই, নেই নতুন শব্দে পাঠককে ভাবিয়ে তোলার ক্ষমতা। সেই মুহূর্তে উপেক্ষা করি তাঁকে। নিজেকে মিশিয়ে দিই উডি অ্যালেনের ‘মিডনাইট ইন প্যারিস’ ছবির সেই হেমিংওয়েতে যে কিনা সুদর্শনা আদ্রিয়ানার প্রশ্নের উত্তরে বলছে তার জনপ্রিয়তার রহস্যঃ আমার লেখা আমার জীবন থেকে নেওয়া। ফকনার আর হেমিংওয়ের সেই দ্বৈরথ, দুই ঘরানার দুই প্রতিদ্বন্দ্বী লেখকের মাৎসর্য্য আজও দেখি আমার চারপাশের সাহিত্যজগতে। তবু আমি ১৯৫২ সালে প্রথম প্রকাশের পর প্রায় সত্তর বছর একে পড়ছি এবং আমার শিল্পীসত্তা কেঁপে উঠছে। এর থেকে বেশি একজন লেখক আর কিই বা আশা করতে পারেন ভবিষ্যতের পাঠকের কাছে?
এই নভেলা হেমিংওয়েকে অসম্ভব জনপ্রিয়তা এনে দিয়েছিল। ১৯৫৩ সালে তিনি পুলিৎজার পান, ১৯৫৪ সালে নোবেল। এই উপন্যাস হেমিংওয়েকে সবকিছু দিয়েছিল। ‘ফর হুম দ্য বেল টোলস্’, ‘আ মুভেবল ফিস্ট’, ‘দ্য সান অলসো রাইসেস’, তাঁর অসাধারন সব ছোটগল্প সবকিছুকে মাথায় রেখেই বলছি ‘দ্য ওল্ড ম্যান অ্যান্ড দ্য সী’ এই নভেলা আমার কাছে তাঁর অন্য সব সৃষ্টির থেকে অনেক বেশি মূল্যবান। আমার সীমিত সাহিত্যজ্ঞান ও আবেগপ্রবণতার অভিশাপ আমাকে প্রবলভাবে এর দিকে টেনে নিয়ে যায়। আর হিংসে হয় লেখকের অমন একটা অভিযাত্রিক জীবনের জন্য, জীবনভর অমন অভিজ্ঞতার জন্য। উনি পিকাসোর প্রেমিকাকে নিয়ে না পালালে কে পালাবে? কেই বা লিখতে না পারার গ্লানিতে মাথায় বন্দুক ঠেকিয়ে আত্মহত্যা করবে? এমন মৃত্যু ক’জনের আর হয়? ফকনার যাই বলুন না কেন, যতই তিনি নিজেকে সমসাময়িক কালের শ্রেষ্ঠ সাহিত্যিক বলে নিজের পিঠ চাপড়ান না কেন আমার মনের ঘোড়ার জিন হেমিংওয়ের অভিমুখেই ঘোরাফেরা করে।