পৃথিবীর প্রথম লাইব্রেরি
পৃথিবীর প্রথম সভ্যতা কোথায় গড়ে ওঠে? কেউ বলবেন সুমেরে দুই নদীর ধারে যাদের গ্রিকরা নাম দিয়েছিল টাইগ্রিস ও ইউফ্রেটিস। কেউ বলবেন মিশরে। কেউ বলতেই পারেন ভারতে সিন্ধুনদের ধারে। নিশ্চিতভাবে বলার উপায় নেই কারণ এই তিনটি সভ্যতাই প্রায় সমসাময়িক। আনুমানিক ৩০০০ খ্রীঃপূঃ। তবে কেউ যদি জিজ্ঞাসা করেন পৃথিবীতে কোথায় প্রথম লিপির প্রচলন হয়? আমরা সবাই নির্দ্বিধায় মেনে নেব যে এর প্রচলন প্রথম শুরু হয় সুমেরে। সারা পৃথিবীর সভ্যতা, জ্ঞান-বিজ্ঞান, মানুষের মনন যুক্তি বুদ্ধির প্রকাশ ও বিস্তার এর পরেই শুরু হয়। এই একটি বিষয়ের জন্য আমরা সবাই সুমেরবাসীর কাছে চিরকাল ঋণী হয়ে থাকব।
প্রাচীন মিশরেও লিপির প্রচলন অনেক আগেই হয়। তবে তারা লিখত প্যাপিরাসে যা নীলনদের ধারে প্রচুর পরিমাণে পাওয়া যেত। যেহেতু তা ভঙ্গুর তাই কালের গ্রাসে সহজেই নষ্ট হয়ে গেছে। তাই সবচেয়ে প্রাচীন প্যাপিরাসের সন্ধান আমরা কখনই পাই নি। কিন্তু সুমেরের লোকেরা লিখত মাটির চারকোণা ট্যাবলেটে। বাঁশের বা কোনো আগাছার তিনকোণা ‘কলম’ দিয়ে কাঁচা মাটির ওপর চাপ দিয়ে লিখে তাকে শুকিয়ে নিত। এই লিপিকে বলা হত কিউনিফর্ম বা কীলকাকার লিপি। ল্যাটিন ভাষায় ‘কিউনি’ মানে কীলক।

প্রথমে ছবির মাধ্যমে এই লিপি তৈরি করা হয়েছিল। পরে যত দিন যায় এতে সাঙ্কেতিক চিহ্ন বাড়তে থাকে। তাই এই লেখালেখির কাজে বিশেষ এক শ্রেণীর মানুষ নিযুক্ত থাকত। এদের বলা হত ‘স্ক্রাইব’ বা ‘লিপিকর’। প্রাচীন সুমেরে এদের অসম্ভব কদর ছিল। এরাই সম্ভবত ছিল পৃথিবীর প্রথম শিক্ষিত অভিজাত শ্রেণী। এই ট্যাবলেটগুলো সংরক্ষণ করে রাখা হত কোনো মন্দিরে বা রাজার প্রাসাদে। পরে যখন অন্য জাতির আক্রমণের ফলে সেই রাজবংশের পতন হত মন্দির বা প্রাসাদ পুড়িয়ে দিলেও সেই ট্যাবলেটগুলো আগুনে পুড়ে আরও শক্ত হয়ে যেত। তাই ধ্বংসস্তূপের মধ্যে প্যাপিরাস পুড়ে নষ্ট হয়ে গেলেও ২৫০০ খ্রীঃপূঃ ট্যাবলেট আমরা প্রায় অবিকৃত অবস্থায় পেয়েছি এবং এদের থেকেই প্রাচীন সুমেরীয় ও তার পরবর্তী সভ্যতা সম্পর্কে আমরা প্রায় সবকিছু জানতে পেরেছি।
সুমেরীয় সভ্যতা প্রায় পাঁচশ বছর টিঁকেছিল। পরে মহান সারগন আক্কাডিয়ান সাম্রাজ্যের প্রতিষ্ঠা করেন। তারা মাত্র ২০০ বছর রাজত্ব করলেও তাদের ভাষা খুব উন্নত ছিল। পরবর্তীকালে কয়েক শতাব্দী ধরে সেই আক্কাডিয়ান ভাষা সেই অঞ্চলের প্রধান ভাষা ছিল। এদের পরে অ্যামোরাইটরা ব্যাবিলনীয় ও তার পরে অসুররা আসুরিয়ান সাম্রাজ্য স্থাপন করেন। সবাই নিজেদের ভাষার সাথে সেই কিউনিফর্ম লিপিকে মিলিয়ে দিয়েছিলেন। তাই বিভিন্ন ভাষার মিশ্রণে সেই লিপি ধীরে ধীরে আরও উন্নত হয়ে ওঠে। রোম ধ্বংস হবার পরেও যেমন ইউরোপীয়রা ল্যাটিন ভাষাকে বাঁচিয়ে রেখেছিল ও আত্মস্থ করেছিল সুমের ধ্বংস হবার পরেও তাদের ভাষা ও লিপির পরম্পরা চলতে থাকে। পরে সিরিয়া, এশিয়া মাইনর, পারস্য, ক্রিট, গ্রিস ইত্যাদি সব উন্নত জাতিই এই লিপি গ্রহণ করে। প্রায় আড়াই হাজার বছর ধরে এই লিপি সারা পৃথিবীতে ব্যবহৃত হয়েছিল। তারপর একদিন মানুষ এর ব্যবহার সম্পূর্ন ভুলে যায়।
১৯৮০ সালে সিরিয়ার আলেপ্পোর কাছে এবলা নামে এক জায়গায় প্রত্নতাত্বিক খননের ফলে ২০০০ ট্যাবলেট পাওয়া যায়। কার্বন ডেটিং করে এর সময় ২৩০০-২২৫০ খ্রীঃপূঃ নির্ণীত হয়। মনে হয় এটা ছিল লিপিকরদের কাজ করার জায়গা বা অফিস। এর পরে ইরাকের নিপুরে অন্য খননের সময় আবার অনেকগুলো এরকম ট্যাবলেট পাওয়া যায়। এদের সময় ধরা হয় ১৩০০ খ্রীঃপূঃ। বর্তমান তুরস্কের রাজধানী আঙ্কারার কাছে হাতুশা নামে এক জায়গায় খননের ফলে বেশ কিছু এরকম ট্যাবলেট পাওয়া যায়। এই হাতুশা ছিল তখনকার দিনের এক বিরাট শক্তি হিটাইটদের সাম্রাজ্যের রাজধানী। এই হিটাইটদের কথা তিন হাজার বছর আমরা বেমালুম ভুলেই গেছিলাম। এখানেই মিটানি বংশের কিক্কুলি নামে একজন ঘোড়া বিশেষজ্ঞের একটি ম্যানুয়াল পাওয়া যায়। চারটি ট্যাবলেটের এই ম্যানুয়ালকেই পৃথিবীর প্রথম ঘোড়া প্রশিক্ষণের ‘বই’ বলে ধরা যেতে পারে।
এই হাতুশাতে যে ট্যাবলেটগুলো পাওয়া যায় তার বিশেষত্ব ছিল এগুলোকে নিয়ম করে সারিবদ্ধভাবে রাখা হয়েছিল। ঠিক যেভাবে কোনো লাইব্রেরিতে ক্যাটালগ অনুসারে বই রাখা হয় অনেকটা সেভাবেই। আরেকটি অবাক করার মত ব্যাপার ছিল কিছু কিছু ট্যাবলেটের শেষে ‘কলোফন’ ব্যবহার করা হয়েছিল। বহু বছর পরে গ্রিকরা এই কলোফন ব্যবহার করা শুরু করে কিন্তু হাতুশার ধ্বংসাবশেষে এর ব্যবহার আমরা খ্রীঃপূঃ ১৪০০ শতকেই লক্ষ্য করে থাকি। এটা খুব অবাক করার মত ব্যাপার।
কলোফন বা ‘ফিনিশিং টাচ্’
তবে এদের কোনোটাকেই আমরা ঠিক লাইব্রেরি বলতে পারি না। প্রথম লাইব্রেরি স্থাপনকারীর নাম যদি আমরা জানতে চাই তবে সেই কৃতিত্ব দিতেই হবে আসুরিয়ান সাম্রাজ্যের প্রধান এক সম্রাট প্রথম টিগলেথ পাইলেসারকে। আনুমানিক ১১১৫ থেকে ১০৭৭ খ্রীঃপূঃ তাঁর রাজত্বকালে তিনি তার প্রাসাদে যা নির্মাণ করেছিলেন তাকে ছোটখাট লাইব্রেরিই বলা যেতে পারে। অসুর বংশের রাজারা দীর্ঘকাল এই অঞ্চলে রাজত্ব করে। সামরিক কুশলতা ও নির্মমতার জন্য তারা ইতিহাসে প্রসিদ্ধ হয়ে আছে। অবরোধ করে কোনো রাজধানী দখল করার কৌশল তারাই প্রথম শুরু করে। তাঁরা তাদের সামরিক বিজয় ও নিষ্ঠুরতার ইতিহাস প্রাসাদের গায়ে লিখে এঁকে খোদাই করে রাখত। কিন্তু এসব ছাড়াও তাঁরা উন্নত সংস্কৃতিমনষ্ক ছিলেন। টিগলেথ পাইলেসারের যে লাইব্রেরি পাওয়া গেছে তাতে যে কিউনিফর্ম লিপিতে লেখা ট্যাবলেট পাওয়া গেছে এতে হিসেবের খতিয়ান ছাড়াও দৈববাণী, মহাকাশের তারাদের বিবরণ, ছোটখাট অভিধান, কিছু জায়গার বিবরণ ছাড়াও এখানেই প্রথম বিভিন্ন গাছপালা ও পশুপাখির নাম ও তাদের বিবরণ পাই। আমরা এই ট্যাবলেটগুলো থেকেই জানতে পারি যে টিগলেথ পাইলেসারই পৃথিবীতে প্রথম চিড়িয়াখানা তৈরি করেন। এই ট্যাবলেটগুলো থেকে আমরা তখন আসিরীয় সভ্যতার সঙ্গীত ও বাদ্যযন্ত্রের কিছু খবরাখবর পাই।
তবে সত্যিকারের লাইব্রেরি বলতে যা বুঝি তা যে সম্রাটের আমলে আমরা প্রথম দেখতে পাই তা এই অসুর বংশের শেষদিকের এক বিখ্যাত রাজা আসুরবনিপালের রাজত্বকালে। ১৮০০ শতকের শেষের দিকে ব্রিটিশরা নিনেভে খনন করার সময় এই লাইব্রেরির সন্ধান পান। সম্রাট আসিরিয়া ও ব্যাবিলনে রাজত্ব করতেন ৬৬৮ থেকে ৬২৭ খ্রীঃপূঃ। তিনি নিজে পন্ডিত ছিলেন এবং তাঁর নিজের প্রজ্ঞা ও লাইব্রেরির জন্য নিজে অসম্ভব গর্বিত ছিলেন। আমরা পরবর্তী সময়ে সুমের বা অ্যাসিরীয় সভ্যতা সম্পর্কে যা জানতে পেরেছি তার জন্য আসুরবনিপালের লাইব্রেরির কাছে আমরা ঋণী। ১৮০০ খ্রীঃপূঃ লেখা গিলগামেশের মহাকাব্য যাকে পৃথিবীর প্রাচীনতম মহাকাব্য বলে স্বীকার করা হয়েছে তা আমরা প্রথমে এখান থেকেই পাই। এই লাইব্রেরিতে প্রায় ৩০,০০০ ট্যাবলেট পাওয়া যায়। যদিও তাদের মধ্যে অনেক নকল করা ‘কপি’ আছে। সেই দিক দিয়ে বিচার করলে অরিজিনাল ট্যাবলেটের সংখ্যা প্রায় হাজার দেড়েক। গিলগামেশ ছাড়াও এপিক অফ ক্রিয়েশন, এপিক অফ ইরা, মিথ অফ আটরাহ্সিস এমন সব সাহিত্য মূল্য সম্বলিত নিদর্শন আমরা সম্রাটের লাইব্রেরি থেকেই প্রথম পাই।
সম্রাট আসুরবনিপাল
সম্রাট এত ট্যাবলেট কোথা থেকে পেলেন? সম্রাট যখন নিনেভে আসিরিয়া সাম্রাজ্যের অধিপতি তখন তার বৈমাত্রেও ভাই ছিল ব্যাবিলনের রাজা। ভাই বিদ্রোহ করলে বিদ্রোহ দমন করে তিনি ব্যাবিলন লুণ্ঠন ও ধ্বংস করলেও ব্যাবিলনের সংরক্ষিত ট্যাবলেটগুলো তিনি গাড়ি বোঝাই করে ৬৪৮ খ্রীঃপূঃ নিনেভে নিয়ে এসে নিজের লাইব্রেরি আরও সমৃদ্ধ করেন। তার মৃত্যুর পরে ক্যালডিয়ান ও মিডিয়ার অধিবাসীরা যখন নিনেভ দখল করে ধ্বংস করে দেয় আগুনে পুড়ে গিয়ে সেই ট্যাবলেটগুলো আরও শক্ত হয়ে যায়। আড়াই হাজার বছরের দীর্ঘ সময় তাই তাদের সম্পূর্ণ নষ্ট করতে পারে নি। আমরা অনেক ট্যাবলেটকে ভাঙ্গা পেলেও অনেকগুলোকে অবিকৃত অবস্থায় পাই।
মনে হয় এই লাইব্রেরি রাজার নিজের ব্যক্তিগত সংগ্রহ ছিল। তবে তাঁর সেক্রেটারিরা একে ব্যবহার করতে পারতেন। অনেক ট্যাবলেটের নীচে কলোফন ব্যবহার করে লেখা হয়েছে, ‘আসুরবনিপালের প্রাসাদ, আসিরিয়ার সম্রাট, দুনিয়ার রাজা’। তবে যে ট্যাবলেটগুলো যেহেতু খুব মূল্যবান ছিল তাই তাদের নীচে লেখা থাকত, ‘কেউ যদি একে ভেঙে ফেলে, জলে ভিজিয়ে নষ্ট করে বা বিকৃত করার চেষ্টা করে তবে অসুর, মাদ্রুক, আনু, এনলিল তাকে কোনোভাবেই ক্ষমা করবেন না’। সম্রাট আসুরবনিপাল যতই দুনিয়ার সম্রাট হোন না কেন তাঁর লাইব্রেরিও চোরদের থেকে মুক্ত ছিল না। সুতরাং ‘বইচোর’ যে আধুনিক সভ্যতার অভিজাত চোর তাই নয় সম্রাটের আমলেও তারা ছিল। তাদের জন্য ট্যাবলেটের নীচে কলোফন ছিল, ‘যারা একে চুরি করবে আনু, এনলিল, মাদ্রুক, অসুর, ইস্তার, শামাশের অভিশাপ থেকে তারা কেউ রেহাই পাবে না’।
গ্রিকরা এর পরে অনেক উন্নত লাইব্রেরি তৈরি করেছিল। আলেকজান্দ্রিয়ার লাইব্রেরি সারা পৃথিবীর জ্ঞানের আকর হয়ে উঠেছিল। কিন্তু সুমেরীয়, আসিরীয়, ব্যাবিলনীয়, হিটাইটরা যে লাইব্রেরির ঐতিহ্য স্থাপন করে যায় তাই পরবর্তীকালে আমরা সারা পৃথিবীতে বহন করে চলেছি। সভ্যতা ধ্বংস হয়ে যায়। জাতিরা হারিয়ে যায় ইতিহাস থেকে, আবার পুনরাবিষ্কৃত হয় হাজার হাজার বছর পরে। কিন্তু সংস্কৃতি ও ঐতিহ্য চিরকালীন ধারায় প্রবাহিত হতে থাকে। ইতিহাস মানুষের স্মৃতিতে সম্পূর্ন অবচেতনভাবে কিভাবে বেঁচে থাকে তা ভাবলে অবাক হতে হয়।