বালি পাস- ট্রেকযাত্রীর অভিজ্ঞতা

(১)

“কচ্ছপ যেমন যেখানেই যায় তার খোলটিকে বয়ে নিয়ে যায় আমরাও যেখানে যাই না কেন আমাদের ঘরবাড়ি সঙ্গে নিয়ে চলি। সেই কারণে যে দেশেই যাই না কেন ভ্রমণ শেষ পর্যন্ত একটি প্রতীকী যাত্রা হয়েই রয়ে যায়। যেখানেই যাই সেখানে আমরা কেবল নিজেদের আত্মচেতনাকেই খুঁজে বেড়াই”। – আন্দ্রেই তারকোভস্কি।

  তাই সকল ভ্রমণ এক অর্থে নতুন কিছু আবিষ্কারের উদ্দেশ্যে নয়, তার মূল উদ্দেশ্য নিজেকেই খুঁজে পাওয়া। এর থেকে সত্যি কথা আর কিছু হতে পারে না। আরো নির্দিষ্ট করে বললে বাইরে বেরিয়ে পড়া আসলে নিজের উৎস, নিজের জীবনের রহস্য খুঁজতে বেরোনো। আমার চার দেওয়ালের বাইরে যে জগত আছে তার সাথে আমার কিসেরই বা সম্পর্ক, কেমনভাবে সে আমাকে বেঁধে রেখেছে, সে আমার কাছে কী চায়, আমিই বা তার কাছে কী চাই, বদলে যাওয়া ভূপ্রকৃতি, বদলে যাওয়া মানুষ, বেড়ে চলা শূন্যতা এসবের সাথে আমি কিভাবেই বা নিজেকে মানিয়ে নেব, কিভাবেই বা নিজেকে দেখব অচেনা নাকাবের নিচে- তাই জানতেই বারবার বেরিয়ে পড়া।

  বেরিয়ে পড়া এমন জায়গায় যেখানে নীরবতাই কথা হয়ে উঠেছে। যেখানে কথা বেমানান। অতিকথা অসহ্য। যেখানে শব্দ এমনই ধারাবাহিক এবং অনন্ত যে শব্দের কোনো উপলব্ধি নেই। শব্দকে সেখানে সহজেই অবজ্ঞা করা যায়। দৃশ্য যেখানে পরিবর্তনশীল এবং চেতনার ওপরে সর্বব্যাপী এক আস্তরন লাগিয়ে রেখেছে সেখানে বারবার এই জনহীন রূপজোয়ারের ক্যানভাস দেখে মনে হয় সৃষ্টিকর্তা যেন শুধুমাত্র নিজেকে খুশি করতেই এই জগতের সৃষ্টি করেছেন।

  ফুটে থাকা বেগুনি আইরিসের উপত্যকা, হলুদ সাদা প্রিমুলার ঘন সবুজের ওপর বুটিবুটি ছোপ, নেড়া পাহাড়ের গা বেয়ে নেমে আসা জালির মত সাদা বরফ, নদীর ওপারে হালকা সবুজ থেকে ক্রমশ ঘন হয়ে যাওয়া সবুজের শেড যাদের বর্শার চূড়া শিশ্নের মত সারাদিন প্রহরী হয়ে জেগে থাকে, কামনা যেখানে কাঙ্খিত, যেখানে খোঁজা-জীবনের হিংস্রতা ও অবমাননা নেই সেই প্রহরীদের পায়ের কাছে ডুবে যাওয়ার মধ্যে নিজেকে বিলিয়ে দেবার এক আনন্দ আছে।

  ক্যামেরা আর কী তুলতে পারে যেখানে সমগ্রতাই এক চিত্র, যেখানে প্রতিটি দৃশ্যই একটি বিনির্মিত ফ্রেম। জলধারা যেখানে যুগে যুগে পাথরের গায়ে ক্ষয় করে করে নিজের ভাষা লিখে গেছে। সে নিজে হারিয়ে গিয়ে আবার ফিরে এসেছে আবার লিখে গেছে। এই প্রকৃতির কবিতা তাই বারে বারে পুনর্লিখিত। ভাষার ওপর ভাষা জড়িয়ে গেছে। আদিকে লুকিয়ে রেখে অবস্থিতিকে ঝাপসা করে দেওয়া হয়েছে। এর পারে এসে দাঁড়ালে আপনার মনে হতে বাধ্য যে কেন আমাদের ধর্মে বারবার জন্মান্তরের কথা বলা হয়েছে। ফিরে ফিরে আসার, চক্রাকারে আবর্তিত হবার কথা বলা হয়েছে। এক নিঃসীম ঘুম এবং চেতনার সম্পূর্ণ অবলুপ্তি থেকে নতুন চেতনায় ফিরে যাওয়া। ভাষার ওপর ভাষা, চেতনার ওপর চেতনা এখানে কেবল জড়িয়ে জড়িয়ে যায়।

  ট্রেকিং এর সাথে ঘুরতে যাবার মধ্যে একটা পার্থক্য আছে। এটা ঠিক ঘোরা নয়। এটি অনুসন্ধান। এটা বিরতি নয় ক্লান্তি। বিনোদন নয় শ্রম। এটি ঠিক তাই বেরিয়ে পড়া নয়। যাত্রা। অভিযাত্রা। সেই কারণেই প্রতিবার ট্রেকিং-এ বেরোনোর আগে একটা উৎকন্ঠা কাজ করে। এবার তা আরো বেড়ে গেছিল। প্রথমে ঠিক ছিল রুপিন পাস যাব। সেভাবেই ব্যবস্থা হলো। কিন্তু মাঝপথে দোলাচল হওয়ায় ঠিক করলাম বালি পাস যাব। বালি পাস কঠিন ট্রেক বলে নয়, এটি অপেক্ষাকৃত নতুন ট্রেক। তাই জানাশোনা কম। আমি পাহাড়ে হাঁটতে যাই, অভিযানে যাই না। সেই শিক্ষা আমার নেই। তাই নতুন জায়গায় যেতে একটু ভয় হয়। তারপর পনেরো দিন ঠান্ডায় ভুগলাম। দুবার অ্যান্টিবায়োটিক খেতে হল। শরীরচর্চা প্রায় কিছুই হয় নি। আর যেখানেই যাই না কেন, সবখানেই আমিই সবচেয়ে সিনিওরি হয়ে যাই। আর সবাই আমার থেকে অনেক ছোট। এবার বালি পাসেই পঁয়তাল্লিশ হবে। মুখের কথা নয়।

  প্রতিবার উত্তরাখন্ডে যাবার আগে কিছু না কিছু দুর্ঘটনা ঘটে। এবারও খাদে বাস উলটে কতজন বাঙালি ট্রেকার মারা গেল। একজন আবার আমার বাড়ি থেকে কিছুটা দূরেই থাকে। খবরের কাগজে ছবি দেখলাম রাস্তার ওপরে তাদের রাকস্যাক উলটে পড়ে আছে। বাড়ির লোকেরা উৎকন্ঠিত থেকে জেদি হয়ে ওঠে। এসব প্রতিহত করে প্রতিবার বেরোতে বেরোতে ভেতরে ভেতরে একটা ক্লান্তি আসে।

  আমি তো পর্বতারোহী নই। তাই জীবন-মৃত্যুর মুখোমুখি আমাকে দাঁড়াতে হয় না। তবু পাহাড়ের প্রত্যন্ত অঞ্চলগুলো এমনই বিপদে ঠাসা যে কোনো মুহূর্তেই সঙ্কট নেমে আসতে পারে। বয়স বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে শরীরের সাথে একটা বোঝাপড়াও সেরে নিতে হয়। উঠতে গেলে হাঁটুতে লাগে, কোমরে লাগে। সেখানে কোনো চোট লাগলে চোট নিয়েই সারাটা পথ চলতে হবে। কোনো উপায় নেই। এত সব কিছুর পরেও নির্জনতার যে ডাক তাকে অবজ্ঞা করার কোনো ক্ষমতাই আমার নেই। তাই আমি আমার আত্মকে খুঁজে পেতে তাকে সঙ্গে নিয়েই রওনা দিলাম।

চারমূর্তির অভিযান।

  কলকাতা এয়ারপোর্ট থেকে প্লেনে করে দিল্লি। সেখান থেকে আমরা চারজন একটা ট্যাক্সি নিয়ে আই এস বি টি কাশ্মীরি গেট। এক রেস্টোর‍্যান্টে পেট পুরে নিরামিষ ভোজন করে রাতের বাসে চেপে দেরাদুন। আমি, অন্বয় আর নীলাঞ্জন বাঙালি। অমেয়া মারাঠী। ও এসেছে মুম্বই থেকে। বাকিদের সাথে পরে মোলাকাত হবে। আমরা এই চারজন গত নভেম্বরে গোয়েচালা করে এসেছি। সেখানেই আলাপ।

বাধ্যতামূলক এয়ারপোর্ট সেলফি।

  সকালে দেরাদুনে পৌঁছে সেদিন আমাদের বিশ্রাম। উঠলাম হোটেল আশ্রয়ে। এখানেই বছর চারেক আগে আমি তপোবন ট্রেকে যাবার সময় ছিলাম। হোটেলের লবি সব অ্যান্টিক জিনিস দিয়ে সাজানো। পঞ্চাশ বছর আগের হার্লে ডেভিডসন চেন দিয়ে ঝুলছে। মার্লোন ব্র্যান্ডো, মেরিলিন মনরো, এলভিস প্রিসলি, জিকো, পেলে, ইওসেবিওর পোস্টার। পুরনো রেকর্ড প্লেয়ার, প্রাচীন কয়েন, ডাকটিকিট এমন নানা জিনিস দিয়ে লবিটা সাজানো। এদের খাওয়া-দাওয়াও খুব ভালো। আমার তো এখানে এসে মনে হল যে চার বছর পরে আমি আবার ঘরে ফিরে এসেছি।

হোটেল আশ্রয়ের সাজানো লবি।

  সেদিন ঘরে শুয়ে শুধুই বিশ্রাম। পরদিন সকাল সকাল স্নান করে গাড়ির জন্য রওনা হলাম। আমাদের সাথে আরো একটি দল চলেছে হর কি দুন। এটি অপেক্ষাকৃত সহজ ট্রেক তাই তাদের দলে ভিড় বেশি। আমাদের দলে চোদ্দজন। সবাই ছেলে। আমরা মিলেমিশে কেউ টেম্পো ট্রাভেলার কেউ সুমোতে উঠলাম। গাড়ি ছাড়ল সাড়ে সাতটা নাগাদ। দেরাদুন পেছনে যেতেই আঁকাবাঁকা পাহাড়ি রাস্তার বিপজ্জনক আবর্তে আমাদের গাড়ি হারিয়ে গেল।

  উত্তরাখন্ডের রাস্তায় কেন যে এত দুর্ঘটনা ঘটে তা সেই রাস্তায় গেলেই বোঝা যায়। এত সরু পাহাড়ি রাস্তা তার মধ্যেও গাড়িগুলো দ্রুত গতিতে চলে। চালাতে হয়। কারণ হিল স্টেশনগুলোর মধ্যে দূরত্ব অনেক। আজ আমরা যাব সাঁকরি। প্রায় ২২০ কিমি রাস্তা। ১০ ঘন্টা লাগবে কম করে। আস্তে চালালে পৌঁছতে অন্ধকার হয়ে যাবে। তাই হামেশাই দুটো গাড়ি মুখোমুখি প্রচন্ড জোরে ব্রেক কষে দাঁড়িয়ে পড়ে। পাশাপাশি জানালায় উত্তপ্ত বাক্যালাপ চলে। দুটো বড় গাড়ি সরু রাস্তা দিয়ে ধীরে পাশাপাশি যখন পারাপার করে তখন জানলা দিয়ে নিচের দিকে তাকাবার সাহস হয় না। তাই এখানে সামান্য ভুলেরও কোনো ক্ষমা নেই।

আলু বোখরা, কিড়া, অ্যাপ্রিকট, পীচ।

  মুসৌরি বাইপাস করে আমরা জুরো বলে একটা জায়গায় প্রাতরাশ সারলাম। এরপর গাড়ি সমানে ছুটেই চলল। মাঝে মাঝে দাঁড় করাতে হল। ছোট একটা ছেলে বমি করছে। সে তার মা-বাবার সাথে হর কি দুন চলেছে। তার বমির ওষুধ কিনতে হবে। রাস্তায় জল খাবার ব্রেক। পথের ধারে বিক্রি হচ্ছে আলু বোখরা। একরকম প্লাম। টকমিষ্টি খেতে। পাঁচশ গ্রাম কিনলাম। তার সাথে শশা। ওরা বলে কিড়া। এর সাথে অ্যাপ্রিকট আর পীচ। উত্তরাখন্ডের জনপ্রিয় ফল। একই সাথে বিক্রি হচ্ছে বোম্বাই আমের শেক, লিচু আর ছোট ছোট আপেল। পাশেই ছোট ঝোরার জল। গলায় মাথায় দিয়ে ঠান্ডা হলাম। এত উঁচুতে অথচ এখনও ঠান্ডার যেন লেশমাত্র নেই। গাড়ি ছুটে চলল। পাশেই বয়ে চলেছে কোনো পাহাড়ি নদী। নাম জানি না। আরো ওপরে উঠে এক জায়গায় লাঞ্চের জন্য দাঁড়ালাম।

জুরোয় ব্রেকফার্স্ট।

  পেটে খুব খিদে। অথচ এতক্ষণের গাড়ির যাত্রায় মাথা ঝিমঝিম করছে। যেখানে বসে আছি সেখান থেকে উত্তর কাশির উপত্যকাকে একটা অর্ধবৃত্তের মত দেখাচ্ছে। দূরে এক গ্রামে বিকেলের আলো পড়েছে। প্রায় পশ্চিমের দেশ। গ্রীষ্মে সাতটা অবধি সূর্যের আলো থাকে। উঁচুতে উঠে গেছে দেওদারের বন। সেসবের মধ্যে দিয়ে আমাদের গাড়ি অনেক্ষণ চলার পর যখন টনস নদীর শব্দ কানে এল তখন বুঝলাম সাঁকরি হয়ত এসে গেছে।

সাঁকরি থেকে দেখা দূরের গ্রাম।

  সাঁকরি যখন পৌঁছলাম তখন বিকেল গড়িয়ে গেছে। সাঁকরি পাহাড়ের প্রান্তিক গ্রাম। টিটিএইচ সাঁকরিতে তাদের নিজেদের রেস্ট হাউস বানিয়ে ফেলেছে। চারদিকের দেওয়ালে নানা জায়গার ট্রেকের চোখ জুড়ানো ছবি। সান্দাকফু, বালি পাস, হর কি দুন, গোয়েচালা, নাগ টিব্বা, এভারেস্ট বেস ক্যাম্প, কেদারকন্ঠ এমন আরো অনেক। সবই পর্যটকদের তোলা।

  আমরা চারজন একটা ঘরে ঢুকলাম। আজই আমাদের আরামের শেষ দিন। কাল থেকে শুতে হবে তাবুতে। মাঠের ওপরে। স্লিপিং ব্যাগের নিচে। আমাদের গাইড মহাবীর। চা খেয়ে ব্রিফিং হলো। একই কথা বারবার শুনতে হয়। এটা আমার নবম ট্রেক। তাই সুরক্ষার কথা নতুন কিছু লাগে না। বারবার জল খাওয়া। ওয়াক হাই স্টে লো। দিনের বেলা টেন্টে না ঘুমোনো। জোরে জোরে হেঁটে নিজের শক্তিক্ষয় না করা। ওয়াক ইন বেবি স্টেপস। হাঁটার লাঠি পাহাড়ের দিকে রাখা। খচ্চর এলে পাহাড়ের দিকে সরে দাঁড়ানো। এসব।

  ক্যামেরা নিয়ে বাইরের ছবি তুললাম। আলো মরে এসেছে। ঘিঞ্জি পাহাড়ি গ্রাম। যেমন হয়। এর মধ্যেই আরো নির্মাণ হচ্ছে। সোয়েটার পরে গালে সান বার্ন নিয়ে কাজ করছে কিছু দরিদ্র গাড়োয়ালি ছেলে। সব একসাথে জট পাকিয়ে আছে। সাঁকরি থেকেই হর কি দুন, কেদারকন্ঠ আর বালি পাসের ট্রেক শুরু হয়। রাস্তার পাশের দোকানগুলোতে ট্রেকিং গিয়ার ভাড়া দেওয়া হচ্ছে। বব ডিলানের মত চুলওয়ালা একটি ছেলে গেছে চরস খুঁজতে। আস্তে আস্তে কথা বলছে দোকানের মালিকের সাথে। বলছে সে ফুঁকবে না কিন্তু একটু গন্ধ তাকে শুঁকতেই হবে।

  রাতের খাবার সেরে তাড়াতাড়ি শুয়ে পড়লাম। লেপের ভেতর আরামের শয়ন। ঘাড়ের কাছে হালকা একটা উৎকন্ঠা ওঁৎ পেতে রয়েছে। বাড়িতে ফোন সেরে নিলাম। কাল থেকে আর টাওয়ার পাওয়া যাবে না। আবার সাতদিন পরে বাড়িতে কথা হবে। মেয়ে খুব চিন্তা করে। এত ছোট হলেও বাবার জন্য তার মনটা সবসময় ব্যাকুল। ভালোবাসা কী প্রেমই বা কী সে তো কিছুই জানে না। তার ছোট্ট হৃদয়টি সবসময় তার প্রিয়তম মানুষটির জন্য তিরতির করে কাঁপতে থাকে। এত দূরে আমিও সেই কম্পন টের পাই। পনিদের টিং টিং শব্দ আর গাড়োয়ালিদের কথার মিশে যাওয়া নিঃশ্বাসে আমার চেতনা ক্রমশ হারিয়ে যায়।

উৎকন্ঠারও তো শুরু শেষ আছে

ভয় যখন নেই তখন সাহসবিদায়

অজান্তে ঘর নিয়েই যখন চলেছি

ঘরের জন্য চিন্তা মুলতুবি থাক

দীর্ঘ রাস্তার এই সাপলুডো ক্রোধ

কালো পেছল ঘুমের কথাই বলে

শীতার্ততার আবেশ থেকে সহিষ্ণুতা

ত্রিভুজ উপত্যকা আসলে একটিই ছবি

প্যানোরামা টানটান চাইছ যখন

আলো তোমার মাথার পেছনে নেই

মৃত্যু বা জীবনের নিরর্থক নির্বাচন

চোরাটানের স্রোতে নেশা ধরিয়ে ফেলেছে

দুর্গম শব্দ তার আভিধানিক আক্ষরিকতা নিয়ে

আমার ভেতরে আমার চারাগাছ বুনেই চলেছে  

(২)

আজ আমরা সাঁকরি থেকে যাব আমাদের প্রথম গন্তব্য পোনিগ্রাড। সকালে তৈরি হয়ে প্যাকড লাঞ্চ নিয়ে রওনা হলাম। সাড়ে আটটা নাগাদ গাড়িতে উঠে বসলাম। কয়েকজন গাড়ির ভেতরে, আর কয়েকজন গাড়ির মাথায়। আঁকাবাঁকা বিপজ্জনক পাহাড়ি রাস্তায় প্রায় এক ঘন্টা গাড়ি চলার পর আমরা তালুকা নামে এক গ্রামে এসে উঠলাম। এখানেই গাড়ির রাস্তা শেষ। তালুকা থেকেই শুরু হবে আমাদের পায়ে হাঁটা।

  রাস্তাটা বিপজ্জনক বললাম ঠিকই কিন্তু ততটাই সুন্দর। এই রাস্তা মূলত পায়ে হাঁটার জন্যই কিন্তু এই বারো কিমি রাস্তায় খুব কম হলেও গাড়ি চলে। পথে অনেক নদী ও কাঠের ব্রিজ পড়ল। সেগুলোর ওপর দিয়েই গাড়ি পার হয়ে গেল। যারা ওপরে বসেছিল পাথুরে রাস্তায় গাড়ি এত দুলছিল যে গাড়ির রেলিং ধরে সারাটা রাস্তা নাকি ইষ্টনাম জপ করতে করতে এসেছে। তালুকায় খুব বেশি হলে পনের কি কুড়ি ঘর লোকের বাস। ৬,৭০০ ফুটের এই ছোট্ট গ্রামে ক্যাম্প করার জায়গা আছে। অনেকেই এখানে ক্যাম্প করে। কয়েকটি পনি পাশের মাঠে চড়ে বেড়াচ্ছে। গ্রামটিতে যত্নের অভাব আছে। কেমন যেন অগোছালো। এলোমেলো। সচরাচর পাহাড়ি গ্রাম এমন হয় না।

  এর মধ্যে পরের গাড়িতে বাকিরা আর মহাবীর এসে গেছে। আমরা এক জায়গায় জমায়েত হলে মহাবীর বলল, ‘একবার জয়জয়কার হো যায়ে’। আমরা সবাই তিনবার বলে উঠলাম, ‘হর হর মহাদেব’। তারপর আমাদের যাত্রা শুরু হল। তালুকা থেকে কিছুটা নেমে আমরা সুপিন নদীর ধার দিয়ে হাঁটতে শুরু করলাম। সুপিন খরস্রোতা নদী। সারাটা রাস্তাই তার তীব্র গর্জন শুনতে শুনতে চললাম। তালুকার কাছে এক জায়গায় দেখলাম ব্রিজ তৈরির কিছু সরঞ্জাম আনা হয়েছে। নদীর ওপর হয়ত ছোট পাহাড়ি ব্রিজ তৈরি হবে।

চলার পথে চায়ের চটি।

  মাথার ওপর খর রোদ। আমরা যদিও বেশিরভাগ রাস্তাই গাছের ছায়ায় ছায়ায় চলছি। গাছ বলতে এখানে মূলত দেওদার, হর্স চেস্টনাট, ম্যাপল, ওয়ালনাট আর সিলভার ওক। ম্যাপলের পাতা এখনও সবুজ। তাতে রং ধরে নি। মহাবীর বলল, ম্যাপল এখানে প্রধানত হালকা আর ঘন পাতার এই দুরকমের হয়। লাইট আর ডার্ক ম্যাপল। পাহাড়ে বেড়াতে এলে এখানের গাছপালা আমাকে খুব আকর্ষণ করে। এসব গাছ আমি তো কোনোটাই আমার চারপাশে দেখি না। তাই চিনে নিতে ইচ্ছে হয়।

গুরাস বা বুরান্সের রস।

  হর্স চেস্টনাট গাছের ছাল থেকে নাকি ‘খারিক’ নামে এক আয়ুর্বেদিক ওষুধ তৈরি হয়। খারিক গাড়োয়ালি ভাষা। এবার বালি পাস ট্রেকে গিয়ে কিছু সুন্দর সুন্দর গাড়োয়ালি শব্দ শিখলাম। রাস্তায় অনেক ছোট ছোট কাঠের ব্রিজ। সেসব ব্রিজ দিয়ে আমরা একবার সুপিনের এপারে একবার ওপারে গিয়ে উঠছিলাম। ঘন্টা দেড়েক হাঁটার পরে আমরা এক ছোট পাহাড়ি চটিতে চা খাবার জন্য ঢুকলাম। প্লাস্টিক টাঙ্গানো ছোট চায়ের দোকান। নদীর ওপরের দিকের পারে পাহাড়ের গায়ে। এক কাপ চা কুড়ি টাকা। দোকানি বলল সে নাকি চায়ের মধ্যে ‘চরু’ বা জরিবুটি মিশিয়ে দিয়েছে। এইসব জরিবুটি ওরা পাহাড় থেকেই সংগ্রহ করে। আমরা গুরাস বা রডোডেনড্রনের জুস খেলাম। লাল গুরাসের রস বিক্রিও হচ্ছে। কিন্তু নেবার উপায় নেই। ব্যাগে বইবে কে? তাই আধা গ্লাস রসই খেলাম। রূপকুন্ড ট্রেকে যখন গেছিলাম তখন দিদনা গ্রামেই প্রথমবার গুরাসের রস খেয়েছিলাম। শুনেছি লাল ছাড়া অন্য গুরাসের নাকি রস হয় না। সাদা বা গোলাপি গুরাসের রস নাকি বিষাক্ত।

হর্স চেস্টনাট গাছ।

  মহাবীর সেখানে বসে বসে ওর ক্যারিয়ারের কথা বলছিল। আপসোস করছিল টাকার অভাবের জন্য। এভারেস্ট অভিযান করতে হলে ত্রিশ থেকে চল্লিশ লাখ টাকা লাগে এখন। স্পনসর জোগাড় করা মুখের কথা নয়। আমি বললাম, আমরা আসার কিছুদিন আগেই আমাদের বাংলার মেয়ে পিয়ালি বসাক এভারেস্ট আর লোৎসে আরোহণ করেছে। মহাবীরের কথায় যেন একটা হতাশা কাজ করছিল। ও মিংমা শেরপার গল্প করছিল। যে এভারেস্টের সিজন না থাকলে নাকি স্টোক কাংড়িতে টেকনিক্যাল গাইডের কাজ করে। মিংমা বলেছে নেপাল সরকারের নাকি শেরপাদের নিয়ে বিশেষ কিছু চিন্তাভাবনাই নেই।

  চা খাওয়া শেষ হলে আবার হাঁটা শুরু হল। কখনও বনপথ কখনও নদীর ধারের পাথুরে রাস্তা। গাছের মধ্যে প্রচুর সাদা সাদা ফুল ফুটে আছে। গাছ বা ফুল কোনোটার নামই কেউ বলতে পারল না। ঘন্টা দুয়েক চলার পর আমরা লাঞ্চ পয়েন্টে এলাম। এর মধ্যে আকাশ মেঘলা হয়েছে। ঝিরঝির বৃষ্টি শুরু হয়েছে। আমাদের প্যাকড লাঞ্চ ‘গোবি’ দিয়ে পোলাও। লাঞ্চ পয়েন্টে চা ম্যাগি অমলেট পাওয়া যাচ্ছে। এক কাপ চা আর একটা অমলেট নিলাম। একটা অমলেট ষাট টাকা। এই ছোট ছোট পাহাড়ি চটিগুলো ট্রেকারদের ভরসাতেই চলে। দোকানিরা মালপত্র নিয়ে বেলায় বেলায় গ্রামে ফিরে যাবে।

  দুটো হিমালয়ান ম্যাস্টিফ আমাদের সঙ্গে চলেছে। বাঘু আর শেরু। একটি নায়ক অন্যটি নায়িকা। তাদের মিলনের উচ্ছ্বাস থাকলেও কেউ কাউকে নিজের খাবারের এক টুকরোও দেবে না। পাহাড়ে খাবার দুর্লভ। এরা এভাবেই বেঁচে থাকে। শিবম দেরাদুনের ছেলে। আমাদের সঙ্গে চলেছে। ও ওদের বিস্কুট দিতে বারণ করল। বিস্কুটে যে গ্লুটেন থাকে তাতে তাদের নাকি গায়ের লোম পড়ে যায়। গায়ের লোম পড়ে গেলে ওরা এই ঠান্ডায় বাঁচতে পারে না। সান্দাকফু যাবার সময় কালিপোখরিতে একটা টিবেটান ম্যাস্টিফ দেখেছিলাম। ওরা আকারে আরো বড় আর ওদের গায়ের লোমও অনেক বেশি হয়।

শেরু।

  অনেকে হর কি দুন করে ফিরে আসছে। আজকে আমরা পনিগ্রাডে ওই ট্রেকের যাত্রীদের সাথে একই সঙ্গে ক্যাম্প করব। কাল থেকে আমাদের পথ আলাদা হয়ে যাবে। বসে আছি একটা বিরাট ওয়ালনাট বা আখরোট গাছের তলায়। বিশাল মোটা আর কালো তার গুঁড়ি। চারিদিকে কালো গাছের গুঁড়ি। আকাশেও কালো মেঘ। এদের মধ্যে গাছের হালকা সবুজ পাতা দিয়ে চারপাশটা সবুজ আলোতে আলোকিত হয়ে আছে।

  খাওয়া শেষ হলে জড়তা আসে। আজ প্রথম দিন। পাহাড়ে হাঁটায় অভ্যস্ত হতে সময় লাগে। বৃষ্টি মাথায় করে পঞ্চ গায়ে চাপিয়ে হাঁটা শুরু হল। আজ আমাদের মোট দশ কিমি হাঁটতে হবে। এখনও চার কিমির মত বাকি আছে। কিছুদূর হেঁটে আমরা খুব সুন্দর একটা জায়গায় পৌঁছলাম। ছোট গ্রাম। নাম গঙ্গোরি। দূরে সেতু দেখা যাচ্ছে। পার হলেই ওসলা। বিখ্যাত গ্রাম। পাহাড়ের ওপর লাল লাল চালের ঘর। সুপিনের নাম এখানে পালটে গেছে। এখন এর নাম তামসা। তামসা তারপর সুপিন। সুপিন নীচে গিয়ে নেটোয়ারের কাছে রুপিনের সাথে মিশেছে। রুপিন আর সুপিন মিলে হয়ে গেছে টনস নদী। এই মোটামুটি এই এলাকার নদীর বিভাজন।

  সামনের দৃশ্যপট এত অপূর্ব যে অনেক্ষণ ঠায় দাঁড়িয়ে থেকে সেই সৌন্দর্য কিছুক্ষণ ধরে উপভোগ করলাম। কিন্তু আকাশ মেঘাচ্ছন্ন। আলো খুবই কমে এসেছে। ঠান্ডাও বাড়ছে। ক্যামেরা বের করে কম আলোতেই সেই সুন্দর দৃশ্যটা তুলে রাখলাম। যেখানে ব্যাগটা নামিয়ে রেখেছি সেটা ওয়াইল্ড রোজ বা বুনো গোলাপের ঝোপ। বালি পাসের রাস্তা ধরে ধরে এই বুনো গোলাপের সাদা আর গোলাপি ফুল আপনাকে রঙ্গিন করে রাখবে।

অপূর্ব সেই দৃশ্যপট।

  গঙ্গোরিতে চায়ের দোকানে লেবুর শরবত খেলাম। ভালো বৃষ্টি শুরু হয়েছে। দোকানের সামনে একটা বিরাট গোল্ডেন ওকের গাছে। কত প্রাচীন গাছ। ঠায় দাঁড়িয়ে আছে। গুঁড়ি কালো হয়ে গেছে। গাঁওবুড়া বলছিল, এমন বৃষ্টি হলে ওপরের বালি পাসে প্রচুর বরফ পড়বে। আমি বরফও চাই আবার বৃষ্টিও চাই না। যদিও জানি দুটো একসাথে হওয়া কঠিন। বৃষ্টি কিছুক্ষণের মধ্যেই ধরে এল। আমরা আবার হাঁটা শুরু করে কিছুক্ষণের মধ্যেই পনিগ্রাডে আমাদের প্রথম ক্যাম্প সাইটে চলে এলাম।

গঙ্গোরির চায়ের দোকান।

  ‘গ্রাড’ শব্দের অর্থ নাকি পেষাই করার যন্ত্র। ‘পনি’ শব্দের অর্থ কেউ বলতে পারল না। এখানে যে পেষাই করার যন্ত্রটা আছে সেটা আমরা আগামি দিন দেখব। আমাদের ক্যাম্প একদিকে, অন্যদিকে হর কি দুনের যাত্রীদের। ওদের অনেক তাবু। ওরা সংখ্যায় আমাদের দ্বিগুণ। আমাদের চোদ্দজনে একটিও মেয়ে নেই। ওদের দলে নারী প্রচুর। আমরা আড়চোখে ওদের মেয়েদের দেখছিলাম। ওরা আমাদের আসার প্রায় ঘন্টাখানেক পরে এল। বিকেল হয়ে এসেছে। তাবুতে ব্যাগ রেখে গরম গরম চা আর আলুর পকোরা। পপকর্ন আর টমেটোর স্যুপ।

পনিগ্রাডে আমাদের তাবু।

  আমাদের তাবু যেখানে খাটানো হয়েছে সেখানটা সমতল জমি। পাশের সমতল জমিগুলোতে গাড়োয়ালি রমণীরা রাজমার চাষ করছে। সবে জমিতে রাজমা বুনেছে। ছোট ছোট সবুজ পাতা মুখ তুলেছে বাইরে। একদম গায়েই তামসা নদীর বিরাট আবর্ত আর প্রচন্ড শব্দ। একটা বিরাট পাথরের ওপর উঠে বসলাম। সারাদিনের ক্লান্তিতে আবর্তিত জলস্রোতের দিকে তাকালে মাথা ঝিমঝিম করে। পাথরটাও অনেক উঁচু। নীচে পড়লে বাঁচার সম্ভাবনা কতটা তাই চিন্তা করছিলাম। নদীর এই চলিষ্ণুতা আমাকে সবসময় খুব আকর্ষন করে। এই একটানা নিরলস বয়ে চলা, এই স্রোত, যুগ যুগ ধরে এই উপত্যকা সভ্যতাকে বাঁচিয়ে রাখা, আমাদের জলজ জীবন, তার জন্য নদীর এই সীমাহীন দান ও ত্যাগ আমাকে খুব প্রভাবিত করে। পাহাড়ে এলেই তাই অনেক্ষণ নদীর ধারে সময় কাটাই। নদীর আমাকে দেখার সময়ও নেই। তার প্রচুর কাজ। আমিই তাই তার দিকে নিশ্চেষ্টভাবে তাকিয়ে থাকি।

উত্তাল তামসা নদী।

  বেলা পড়ে এল। প্রায় সাতটা বাজে। ঠান্ডা বাড়ছে। গাড়োয়ালি রমণীরা তাদের গ্রামে ফিরে গেছে। আমাদের ট্রেক লিডার মহাবীর ডাক দিচ্ছে তাবুতে আসতে। প্রতিদিন এই সময় পরের দিনের সময়সূচি জানানো হয়। মহাবীর বলছিল এই তামসি নদীটির উৎপত্তি হয়েছে হর কি দুনের কাছে চৌনধার হিমবাহ থেকে। ও নাকি হর কি দুন ট্রেকের সময় কয়েকজনকে নিয়ে চৌনধার হিমবাহের দিকে এগিয়ে গিয়েছিল। কিন্তু হিমবাহ অনেকটা দূরে সরে যাওয়ায় তার ওপর পা রাখতে পারে নি।

  রাতে ডিনার ভাত, ডাল, ডিমের তরকারি আর কাস্টার্ড। এই যে ডিম খেলাম আবার কবে খাব কে জানে? আদৌ আগামি দিনগুলোতে ডিম জুটবে কিনা সন্দেহ আছে। আরো দুয়েকটা ম্যাস্টিফ এসে জুটেছে। কিন্তু এদের গলায় লোহার সরু পাতের বকলস পরানো। আমাদের লোকাল গাইড অমর বলছিল এরা নাকি সব শেফার্ড ডগ। ভেড়ার পালের সাথে সাথে যায়। নেকড়েদেরকেও ভয় পায় না। তবে নেকড়েরা যেহেতু টুঁটি চেপে ধরে তাই টুঁটির জায়গায় বকলস লাগিয়ে রাখা হয়। এতে অনেকেই বেঁচে যায়।

  চিতাকে গাড়োয়ালিরা বলে তেন্দুয়া। এইসব অসুরক্ষিত পাহাড়ি গ্রাম তেন্দুয়াদের নির্ভিক বিচরণক্ষেত্র। এরা মানুষের একই সাথে সহাবস্থান করে বলা যায়। এই ম্যাস্টিফরা এদের প্রহরী। এরা থাকলে কখনও তেন্দুয়াও কাছে আসতে ভয় পায়। নয়ত চিৎকার করে গ্রামবাসীদের জাগিয়ে দেয়। মহাবীর বলল, কুকুর আছে তাই রাতে বাইরে গেলে ভয় নেই। তবে অনেকসময় খাবার লোভে কিছু পাহাড়ি শিয়াল চলে আসে। তবে তারা মানুষকে আক্রমণ করে না। রাতে না উঠলেই মঙ্গল। যদিও এই ৮,৫০০ ফুট উচ্চতায় তেমন ঠান্ডা নেই। তবু রাতে স্লিপিং ব্যাগের মায়া কাটিয়ে বাইরে যাওয়া খুবই কঠিন কাজ।

… হিমবাহের সন্ততিরা জননীকে ফেলে যতদূর যায় পাগল-পাগল হয়ে ওঠে। এই গতি মোচড় ঘূর্ণন অবিরত বারবার যুগান্তর কেবল পিছে ফিরে আসে। জীবন এক বসন্ত থেকে অন্য বসন্তে, এক শস্য থেকে অন্য শস্যে চক্রাকার। এই জলধারা বোধ। ছুঁয়ে থাকা জীবন, দেহ, হে মন, আত্মন্‌ অস্পষ্ট দাগ সারাদিন। যে সৃষ্টিতে হাত লাগে নি, রূপে নেই চকিত পল্লব মেঘের ছায়ায় সবুজ নীলাব্জতায় একটা বিষণ্ণ প্রেক্ষাপট জুড়ে বিকেলের অলসতা ছড়িয়ে যাবে। কাঁটাবাস বুনো গোলাপ সোনালি ওকের ধারে প্রাচীন বৃদ্ধ গঙ্গোরি মেষপালকদের দুর্ভাবনায় থমথম। পিছে ফেরা যখন নেই প্রতিটি দৃশ্যই আশ্চর্য ও শেষ। তেন্ডুয়ার নিঃশ্বাসের বাষ্পে কারো কারো নাকের লোম কেঁপে ওঠে…

(৩)

সকালের জলখাবার পোহা আর পাস্তা। এই পাস্তা বা ম্যাকরনি আমার একদম পছন্দের মধ্যে পড়ে না। আমি পোহা খেয়েই পেট ভরে নিলাম। আজ আমাদের খুব বেশি হাঁটা নেই। পাঁচ কিমির মত হাঁটতে হবে। আজ ক্যাম্প করব দেবসু বুগিয়ালে। ৯,৮০০ ফুট উচ্চতায়। তাই আমাদের আজকে হাঁটা নিয়ে কোনো টেনশন নেই। গল্প করতে করতে আর দেখতে দেখতে পথ চলব।

  সকালে রওনা দেবার আগে আরেকবার তামসার পাশে গিয়ে বসলাম। এখানে হয়ত আরেকবার আসব। হর কি দুন ট্রেকটা ছোট। মেয়েকে নিয়ে করার ইচ্ছে আছে। একবার ওকে নিয়ে আসব। জানি সেসময় এলেও এই নদীর কিছুমাত্র পরিবর্তন চোখে পড়বে না। ভোরের আলো হিমবাহ গলা ঘোলাটে জলের ওপর পড়েছে। বেশ শীত শীত করছে। বেশিক্ষণ বসার উপায় নেই। ট্রেকে সবকিছুই ঘড়ি ধরে চলে। সাড়ে আটটা মানে সাড়ে আটটা। তাই তাবুতে ফিরে ব্যাগ গুছিয়ে তৈরি হয়ে নিলাম।

  দুজন লোকাল গাইডের একজন অমিত আজ আমাদের সাথে যাবে না। ওর জ্বর এসেছে। ও হর কি দুন হয়ে সাঁকরিতে ফিরে যাবে। তার জায়গায় এল দীপক। গাড়োয়ালি ছেলে। নির্মেদ চেহারা। থুতনির নীচে লালচে দাড়ি। গায়ে একটা লাল রঙের হলোফিল জড়ানো। সারা ট্রেক ও এটা পরেই কাটিয়েছে। অন্যজন অমর। সে তো প্রথম দিন থেকেই আমাদের সাথে আছে।

সীমা গ্রামের শিবমন্দির।

  রওনা হবার কিছুক্ষণের মধ্যেই আমরা একটা ছোট গ্রামে এসে পড়লাম। এই গ্রামের নাম সীমা। অনেকে প্রথম দিন পনিগ্রাডে ক্যাম্পিং না করে এখানেও থেকে যায়। গ্রামে একটা মন্দির আছে। লোকজন বেশি চোখে পড়ল না। পাহাড়ি গ্রামে সকালবেলা খুব ব্যস্ততার সঙ্গে কাটে। মেয়েরা হয়ত রাজমার ক্ষেতে গেছে। ছেলেরা গেছে ভেড়া চড়াতে বা চটি সামলাতে। ভাবতে ভাবতেই প্রায় হাজারখানেক ভেড়া–বকরির এক পাল আমাদের রাস্তার পাশে ঠেলে দিয়ে হুড়মুড় করে চলে যেতে লাগল। বকরিদের ছেলেগুলোর মাথায় একেকজনের শিঙে একেকরকম নকশা। তারা অনেকেই আবার লাফাতে লাফাতে ভেড়াদের গায়ের ওপর গিয়ে উঠে পড়ছে।

পাহাড়ের ওপরে দেখা যাচ্ছে ওসলা গ্রাম।

  ভেড়াদের পাল চলে গেলে উল্টোদিকের পাহাড়ে তাকালাম। চোখে পড়ল বিখ্যাত গ্রাম ওসলা। উত্তরাখন্ডের অত্যন্ত ঐতিহ্যবাহী মিথিক গ্রাম এই ওসলা। ভারতের মধ্যে একমাত্র এখানেই নাকি দুর্যোধনের পূজা হয়। হর কি দুন ট্রেকের সময় এই গ্রামের মধ্যে দিয়ে যেতে হয়। কথিত আছে মহাভারতের যুদ্ধের আগে দুর্যোধন নাকি এখানে এসেছিলেন। উনি আসার পরে গ্রামের লোকেদের প্রচুর সমৃদ্ধি হয়। তাই তারা তাদের রাজাকে তখন থেকে দেবতা বলে পূজা করে আসছে। ওসলার লোকেরা নাকি মহাভারতের যুদ্ধে কৌরবদের হয়ে লড়াইও করেছিল।

পেছনে ভেড়ার পাল।

  সামনেই দেখা যায় স্বর্গারোহিনীর চূড়া। কেউ কেউ আবার বলেন দুর্যোধন নাকি এই গ্রামের পথ দিয়েই স্বর্গে গেছিলেন। এখানে একটা মন্দির আছে সোমেশ্বর মহাদেবের। প্রতিবছর গাড়োয়ালি প্রথা মেনে পাশের সব গ্রাম থেকে ডোলি আসে উৎসবের সময়। মন্দিরের দরজা সেইসময় ছাড়া অন্য সময় বন্ধ থাকে। কেউ কেউ বলেন তারা নাকি এখনও গোপনে সেই সোমেশ্বরদেবের মন্দিরে দুর্যোধনের পুজো করে।

  দীপককে এই নিয়ে জিজ্ঞাসা করায় ও এই কথার তীব্র প্রতিবাদ করল। ও বলল, ‘এটা কিভাবে হয় স্যার? দুর্যোধনের পূজা কেউ করতে পারে? এই নিয়ে একজন প্রথম একটা বই লিখেছিল। তা নিয়ে সারা উত্তরাখন্ডে প্রচুর জলঘোলা হওয়ায় সেই বইটি নিষিদ্ধ ঘোষণা করা হয়েছে। ওখানে দুর্যোধন নয়, সোমেশ্বরদেবেরই পুজো হয়’।

  কে ঠিক কে ভুল জানি না। উত্তরাখন্ডে গেলে প্রতি মোচড়ে মোচড়ে মিথলজি। বিশ্বাস অবিশ্বাসের কোনো জায়গাই নেই। সীমা পার করে আমরা একটা ফাঁকা জায়গায় এলাম। একটা সাঁকো। বেশ চওড়া। তার ঠিক উল্টোদিকে একটা অপূর্ব সুন্দর জলপ্রপাত। লোকে মুসৌরিতে কেমটি প্রপাত দেখতে যায়। কিন্তু এই অচিন পাহাড়ে অনামী প্রপাতটা তার থেকে বহুগুণ সুন্দর, দুর্গম ও রহস্যময়। বাইরের লোক তার খবরই রাখে না। আমাদের মত হাতে গোনা কিছু ট্রেকার বছরের কয়েকদিন হাঁটার পথে একে দেখে যায়। কেউ তার একটা নাম পর্যন্ত দেয় নি।

অনামী পাহাড়ি প্রপাত।

  অথচ প্রপাতের জলের বিরাট এক গুরুত্ব আছে এখানের কয়েকঘর গ্রামবাসীর কাছে। জলধারা যেখান থেকে নেমে এসে নীচে তামসার সাথে মিশেছে সেই মুখে ওরা একটা কাঠের পাটাতন দিয়ে রেখেছে। ওটা সরিয়ে দিলে জল নীচে জোরে বয়ে যাবে। নীচে গুহার ভেতরে একটি প্রাচীন শস্য পেষাই করার পাথরের যন্ত্র আছে। জলের চাপে তার চাকি ঘুরবে ও শস্য পেষাই হবে। এটিই সেই গাড়োয়ালি ভাষায় ‘গ্রাড’ বা শস্য পেষাইয়ের যন্ত্র। কত কালের প্রাচীন প্রযুক্তি কে জানে? কয়েক হাজার বছরও হতে পারে। এই গ্রামে বিদ্যুৎ নেই। মোবাইলের সংযোগ নেই। গাড়ি নেই। এরা বাইরের পৃথিবী, প্রযুক্তি থেকে বিচ্ছিন্ন। এরা যেন অন্য গ্রহের মানুষ। বেশিরভাগ লোক গাড়োয়ালি ছাড়া অন্য ভাষাও জানে না।

শস্য পেষাই করার যন্ত্র।

  অমরের এক তুতো বোনের সাথে ওর দেখা হল। পিঠে চুবড়ি ভর্তি করে পাহাড় থেকে গবাদি পশুর জন্য পাতা বয়ে নিয়ে আসছে। সরু পাহাড়ি বাঁশ দিয়ে বানানো চুবড়ি। এরা বলে ‘গিলটা’। মেয়েটির মনে হয় কিছু দাওয়াই দরকার। এখানে না আছে দাওয়াখানা না ডাক্তার। মহাবীর ওকে কিছু ওষুধ দিল। প্যারাসিটামল জাতীয়। মুখটা কৃতজ্ঞতায় ভরে উঠল। প্রপাতকে পেছনে রেখে আমরা চরাইয়ের রাস্তায় পা বাড়ালাম।

বন্য গোলাপ।

  পথে একটি বাচ্চা মেয়ে। আমার মেয়ের চেয়েও অনেক ছোট। দেখে আমার পুচুর কথা মনে হল। একটা বিস্কুটের প্যাকেট দিয়ে ওর সাথে ছবি তুললাম। ও হিন্দি জানে না। দীপক বলল ওর নাম সানিয়া। গালে সানবার্ন। ওয়াইল্ড রোজের মতই গোলাপি ওর মুখে। আজকের সারা রাস্তায় এই ফুল ফুটে আছে আরো অনেক। পাথরের খাঁজে খাঁজে রয়েছে ওয়াইল্ড স্ট্রবেরিজ। সানিয়া পাকা পাকা স্ট্রবেরি খুঁজে খুঁজে খাচ্ছে। তা দেখে আমার বার্গম্যানের ‘ওয়াইল্ড স্ট্রবেরিজ’ সিনেমার কথা মনে হল। আমার দেখা বার্গম্যানের প্রথম ছবি। খুব প্রিয়। কোন একদিন ডাক্তার আইসাক বর্গের মত আমিও হয়ত বৃদ্ধ বয়সের স্মৃতিচারণায় নিজের সাফল্য ব্যর্থতা প্রেম এসব নিয়ে ভাবতে বসে এই অচেনা পাহাড়ি গ্রামের কথা, এই বালিকার কথা মনে করে দিবাস্বপ্নে ঝিমিয়ে পড়ব। জীবন তো একটা প্রলম্বিত স্বপ্ন বই কিছু নয়।

সানিয়া।

  কিছুদূর গিয়েই দেখি একটা কোবরা লিলি। এটা পাহাড়ের একটা বিষাক্ত গাছ ও ফুল। অনেক গবাদি পশুরা ভুল করে একে খেয়ে ফেলে অনেক সময় বিষক্রিয়ায় মরে যায়। ফুলটা সত্যিই দেখতে কোবরার ফণার মত। মহাবীর বলছিল ছোটবেলায় সেও নাকি ওয়াইল্ড স্ট্রবেরি খুঁজতে খুঁজতে বালকের অনুসন্ধিৎসায় একবার এই ফুল খেয়ে অসুস্থ হয়ে পড়েছিল। তারপর তার মা তাকে দই খাইয়ে সুস্থ করে তোলেন।

কোবরা লিলি।

  একটা চটিতে আবার দাঁড়ালাম। মহাবীর বলল, এটাই বালিপাসের শেষ ম্যাগি পয়েন্ট। এর পর আর কিছু নেই। আমি তাই একটা ম্যাগি, চা আর অমলেটের অর্ডার দিলাম। অনেকে এসেছে। একদল ব্ল্যাক পিক সামিট করে ফিরছে। তাদের মুখে কালো সানবার্নের দাগ। ব্ল্যাক পিক নন টেকনিক্যাল ক্লাইম্ব। অনেকেই করে। দোকানি রমণী বলল, ডিম শেষ। তাই চা আর ম্যাগিই খেলাম। মাথার ওপরে রোদ বেশ কড়া। তবে শীতল হাওয়ায় রোদ ভালো লাগছে। একটু বসে থাকলেই ক্লান্তিতে চোখ জড়িয়ে আসতে চায়। তাই উঠে পড়তে হয়।

  রাস্তায় দেখা গেল একপাশে অনেক সিডার গাছের সারি। মহাবীরের কথা শুনে বুঝলাম ওরা স্থানীয় ভাষায় একে বলে চিডার। এই গাছের ছাল নাকি চায়ের সাথে মিশিয়ে গরম করে খেলে অ্যাজমায় অনেক আরাম হয়। পাহাড়িরা তাই শ্বাসকষ্টের জন্য একে ব্যবহার করে। পথে পড়ল অনেক চীর পাইনের গাছ। উচ্চতা যত বাড়ছে তত পাইনের বনভূমি বেড়ে যাচ্ছে। গ্রামবাসীরা এই গাছের কান্ডের ছাল কেটে রেখেছে। ওই কাটা জায়গা দিয়ে যে রস বের হবে তাকে শুকিয়ে খুব ভালো আগুন জ্বালানোর কাজে ব্যবহার করা হয়। বনে যখন দাবানল লাগে তখন নাকি ডাল বা পাতার ঘর্ষণে যে আগুন লাগে তার জন্য এই চীর পাইনের দেহরস অনেকখানি দায়ি।

  উল্টোদিকের হর কি দুন উপত্যকায় এক ধরনের ম্যাজেন্টা রঙের বুনো ফুল এত ফুটে রয়েছে যে দেখে মনে হচ্ছে সেই পাহাড়ে যেন আগুন লেগেছে। অথচ কেউ দেখলাম সেই ফুলের নাম জানে না। পরিমল ভট্টাচার্যের ‘শাংগ্রিলার খোঁজে’ বইতে যে ফ্র্যাঙ্ক কিংডন ওয়ার্ড বলে সাহেবের নাম আছে, যিনি হিমালয়ের গাছপালা এবং ফুল নিয়ে দীর্ঘদিন গবেষণা করেছিলেন তার জার্নাল পড়ার একটা ইচ্ছে অনেকদিন হল মনের মধ্যে পুষে রেখেছি। ফুলটার নাম না জানায় সে ইচ্ছে আরো বেড়ে গেল।

  লম্বা একটা চরাই ভেঙে অনেকটা যখন উঠেই চলেছি তখন উঁচু পাহাড়ের খাঁজে দেখলাম বিরাট আকারের কয়েকটা মৌমাছির চাক। চারিদিকে বেশ কিছু মৌমাছি উড়েও চলেছে। এগুলো সব হিমালয়ের মৌমাছি। এ থেকে নাকি লাল রঙের মধু হয়। অরুণাচল ও নেপালে গিয়ে দেখেছিলাম এমনই বিরাট আকৃতির চাক। একেকটির ওজন প্রায় ২০ কেজি হয়। পাহাড়ে মৌমাছি সংগ্রাহকদের একটি সম্প্রদায় থাকে। তারা শুধু বাঁশের দড়ি ও কঞ্চি নিয়ে জীবনের অসম্ভব ঝুঁকি নিয়ে পাহাড়ের এই খাড়াই ভয়ঙ্কর ক্লিফে উঠে মৌমাছির চাক সংগ্রহ করে। ওপরে ওঠার আগে নীচে পাতায় আগুন লাগিয়ে আগে মৌমাছিগুলোকে তাড়িয়ে দেয়। মহাবীর বলছিল এই লাল মধু নাকি সরাসরি সবাই খেয়ে সহ্য করতে পারে না। একে একটু গরম করে খেতে হয়। শুনেছি রোমান সৈন্যরা যখন যুদ্ধের জন্য সারা পৃথিবীতে ঘুরে বেড়াত তখন এই পাহাড়ি মধু তাদের খুব প্রিয় ছিল।

পাহাড়ে মৌমাছির চাক।

  আর কিছুক্ষণ চলার পরেই আমরা দেবসু বুগিয়ালে এসে উপস্থিত হলাম। বুগিয়াল হল পাহাড়ের ওপরে ঘন ঘাসের বিস্তীর্ণ জমি। গাছের সারি মোটামুটি ১০,০০০ ফুট উচ্চতা থেকে শেষ হয়ে যায়। তখন কোনো কোনো জায়গায় এই বুগিয়াল গড়ে ওঠে। রূপকুন্ডে আলি আর বেদিনী বুগিয়ালের ছবি মনেই আঁকা ছিল। কিন্তু এটি তাদের থেকেও সুন্দর লাগল। মাঠের ওপর প্রচুর সাদা প্রিমুলা ফুটে আছে। চারপাশে সিলভার ফারের ঘন সবুজ জঙ্গল। পনিরা শান্তভাবে ঘাস খেয়ে চলছে। দূরে দেখা যাচ্ছে বান্দরপুছ পর্বতের একটি চূড়া আরো অনেক নাম না দেওয়া পাহাড়ের চূড়া।

  এই বুগিয়ালে জলের খুব সমস্যা। একটি তিরতির করে জলের ধারা নেমে এসেছে। আমাদের উল্টোদিকে তাবু খাটিয়েছে বিকাট ট্রেকিং গ্রুপ। আমাদের স্থায়ী তাবু। ওদের অস্থায়ী। একটি জবরদস্ত পাঞ্জাবী যুবক তার ছিপছিপে বান্ধবীর প্রচুর তদ্‌বির করছে। দুপুরে রান্নার সময় কম পাওয়া গেছে। মেনু ডাল ভাত আর পাঁপড়। তাই দেবার সাথে সাথেই নিঃশেষ হয়ে গেল। পাহাড়ে উচ্চতা বাড়তে থাকলে আমি খাওয়া কমিয়ে দিই। কিছুটা খিদেও কমে যায়। কম খেলে শরীর ভালো থাকে। ভালো হাঁটতে পারি।

দেবসুতে আমাদের ক্যাম্প।

  বিকেলে সবাই অ্যাক্লাইমেটাইজেশন ওয়াকে গেল। আমি বুগিয়ালের ওপর একটা পাথরের ওপর বসে বিকেলে আলো দেখছিলাম। এখানে আলো অনেক্ষণ থাকে। অনেক্ষণ থেকে ভাবছি আলো একটু কমলে ছবি নেব কিন্তু বিকেল আর হচ্ছিল না। রোদও খুব কড়া। তাই বসে বসে আলোর কথা ভাবছিলাম। আলো একদিকে সবকিছু প্রকাশ করে আবার সেই আলোর তীব্রতা সব কিছুকে এত রূঢ় করে তোলে যে তার সৌন্দর্য ম্লান হয়ে যায়। আমরা আলোর ম্লানতার জন্য অপেক্ষা করি। কখন সে চারপাশকে আরো রহস্যময় করে তুলবে। আলো তাই একই সাথে প্রকাশ্যতা ও অপ্রকাশ্যতার সূচক। কোনোটাই যেন মূল্যহীন নয় এ জীবনে। জীবন জুড়ে আমার গোপনীয়তা। আমার হৃদয়ে আলো-আঁধারি, রহস্যময়তা। আমি নিজেই নিজেকে চিনি না। এই মন্দ্র প্রান্তর, জনমানবহীন বুগিয়াল, যেখানে আর কখনও ফিরে আসব না এরা আমার স্মৃতির কত তলায় হারিয়ে যেতে পারে, এই রং এই ছায়া কত দিনে ফ্যাকাসে হয়ে যাবে, হাতড়ে হাতড়ে আছারিপিছারি করে তুলে আনতে হবে স্মৃতির মানচিত্রে- সে কতদিন? সে কতযুগ? আমি কি সত্যিই এখানে আগে আসি নি? তবে এত কিসের টান? নীরবতা এত কেন রূপের মায়া নিয়ে মোহজাল তৈরি করে রেখেছে। আমি যে চোখ বুজব সে উপায় কই? আমি যে নিজেকে খুঁজব সেই প্রেরণা কই?

রূপসী দেবসু।

  রাতের মেনু ভাত, রুটি, ডাল আর বাঁধাকপির তরকারি। সঙ্গে দেড়খানা করে জিলিপি। আহা জিলিপি! এরা প্রতিদিন রাতে একটা মিষ্টি রাখবেই। একেকদিন একেক। আমরা সেই প্রান্তিক মেনুটির জন্য অপেক্ষা করে থাকি। প্রায় দশ হাজার ফুট। বাইরে নিকষ কালো আঁধার। তার সাথে যথেষ্ট ঠান্ডা। রাত সাড়ে আটটা বাজে। পাহাড়ের জন্য অনেক রাত।

নাম দিয়ে যাকে চিহ্নিত করো নি

সে অনির্দিষ্ট অসম্পূর্ণ গতিময় এক আনন্দ

সভ্যতার স্রোতে যারা পথ হারায় নি

জানে না তারা এই পথের কোথায় আছে

জ্ঞান না অজ্ঞান পরিচয় না বিস্মৃতি

পথ তো এক নয় কে চিনিয়ে দেবে

জীবনস্রোত যেখানে পাতায় জলে ফুলে

স্ট্রবেরি লাল বালিকা দারিদ্র জানে না

গিলটায় ভরে ওঠা পাহাড়ি পাতার ঝোপ

মাটির গুনে কাল আবার ভরে যাবে

এরা নদী পাথর গ্রাডের শব্দ নিয়ে বেঁচে আছে

তুমি শুধু ঘনঘন এখানে এসো না

(৪)

…যোনিই নারী নাকি নারী যোনি? যুগান্তরের শস্যমাতা সন্তানের হাত ধরে আছে প্রেমিকের মমতায়। সারাটা দেশ জুড়ে ছড়িয়ে যাওয়া বীজ জলের আধারে মাটির গর্ভে আমানি নিয়ে বসেছে। হে মাতা, সারা অববাহিকায় বিস্তৃত যদি তোমার স্নেহ যারা ডোলি করে পনির পিঠে, কুলির পিঠে, পায়ে হেঁটে তোমার কাছে এসেছে তারা কি তোমায় পায় নি? ভক্তির ভাঁটায় এ জীবন শুধু রূপের নৈবেদ্য খুঁজে চলেছে। তুমি কি আমার হাত ধরেছো মা? জানতে চাই তুমি আইসিস না অম্বিকা…

   সকালের জলখাবার প্যানকেক, মধু, সরু আলুর পরোটা আর টম্যাটো স্যুপ। বেশ তৃপ্তি করে খাওয়া হলো। আজ আমাদের যেতে হবে প্রায় ১২ কিমি রাস্তা। ঘন্টা ছয়েক হাঁটতে হবে। আজ আমরা যাচ্ছি রুইনসারা তাল। এর উচ্চতা প্রায় ১১,৮০০ ফুট। ১২ কিমি রাস্তায় প্রায় ২০০০ ফুট ওপরে উঠতে হবে। তাই বেশির ভাগ রাস্তাটাই ধীর চরাই। আমরা আস্তে আস্তে উঠতে থাকব রুইনসারার দিকে। প্রায় গোটা পথটাই তামসা নদীর পার ধরে ধরে। রাস্তায় তাই জলের অভাব নেই। নদীর ধার বলে কিছু গাছের ছায়াও থাকবে। চলাটা মনে হয় উপভোগ্য হবে।

এবার দেবসুকে ছেড়ে যেতে হবে।

  ব্যাগ গুছিয়ে দেবসু বুগিয়ালের দিকে একবার ফিরে তাকালাম। বিকাটের দল ক্যাম্প গোছানোর চেষ্টা করছে। আমাদের তাবুগুলো থেকে যাবে। আমাদের রানিং ক্যাম্প নয়। গোছগাছের সময় বুগিয়ালকে কিছুটা অবিন্যস্ত লাগছিল। আর তো এখানে আসব না কোনোদিন। বুগিয়ালের দিকে তাকিয়ে কেন জানি ভেতরে তেমন অনুরাগ বোধ করলাম না। সেও তো জানে আমি আর আসব না। আমার চোখে তাই গতকালের মত আর মায়াকাজল পরিয়ে দিচ্ছে না। আমরা চলে গেলে সে আবার সকালের রোদে নতুন প্রিমুলার দল নিয়ে নিজেকে সাজিয়ে তুলবে। প্রকৃতি কি অভিমানী নাকি আমরা স্বার্থপর?

  যে জায়গা ছেড়ে চলে যাচ্ছি তার জন্য মনে যেন তীব্র কোনো অনুরাগ নেই। যার দিকে যাচ্ছি সেই রুইনসারা তাল, পথের দুর্ভাবনা মনকে অধিকার করে আছে। আজ যখন ঘরে বসে তার কথা লিখছি তখন তার না দেখা রূপটাই আমার কাছে ফিরে ফিরে আসছে। কল্পনা বাস্তবের থেকে অনেক সুন্দর কারণ তা মিথ্যে। আমি তাই কল্পনাকে আশ্রয় করে থাকি। আজ সেই কল্পনায় দেবসু আমার কাছে নতুন নতুন রঙ্গে রঙিন হয়ে উঠছে। একদিন তা হয়ত আমার স্বপ্নে মিশে যাবে। ফ্রয়েড যতই বলুন না কেন স্বপ্ন সাদাকালো, আমি স্বপ্নে কিন্তু বেগনি রঙের আইরিস হালকা মাখন রঙের ব্রহ্মকমল দেখেছি।

  সিলভার ফার বনের মধ্যে দিয়ে অনেকটা পাতাল প্রবেশের পরে আমরা তামসা নদীর ব্রিজের কাছে পৌঁছলাম। অনেকটা নামা। দুদিন আগে বৃষ্টি হয়ে গেছে। ঘন বনের মাটি সহজে রোদের উষ্ণতা পায় না। তাই পেছল মাটিতে পা দিয়ে সাবধানে নামতে হচ্ছে। তবে গোয়েচালায় জোংরি থেকে থানসিং যাবার সময় যে রাস্তা নেমেছিলাম, ফালুট থেকে রাম্মাম নামার রাস্তার কথা মাথায় রেখেও বলছি, তেমন উৎরাই পথ আমি জীবনে নামি নি। যদিও এই কথা যখন ভাবতে ভাবতে চলেছি তখন হয়ত ভগবান আমার কথা শুনে হেসেছিলেন। কারণ আর তিনদিন বাদেই আমার এই ধারনাকে বদলে নিতে হবে।

তামসার ওপর ব্রিজ।

  বেশ শক্তপোক্ত কাঠের ব্রিজ। ব্রিজের মুখে দীপকের সাথে একটা সেলফি নিলাম। ব্রিজ পার হয়ে জল খেয়ে আবার হাঁটা শুরু। একদম নদীর ধার ধরে ধরে। কানে আসছে নদীর তীব্র শব্দ। দীর্ঘক্ষণ সেই শব্দ কানে আসতে আসতে তৈরি হচ্ছে বিস্মৃতি। শব্দকে আর খেয়াল করি না তখন। নদী পাহাড়ের পাথর ক্ষয় করে অনাদিকাল ধরে পাথরের গায়ে নানারকম ভাস্কর্য তৈরি করে। সেই বিভিন্ন আকৃতির পাথরগুলো দেখলে কল্পনায় নানান মূর্তি ভেসে ওঠে। ইচ্ছে হয় সব কয়টি পাথর খুঁজে খুঁজে দেখি তামসার বরপুত্র বিভিন্ন শিল্পীরা তাদের গায়ে কী কী ভাস্কর্য এঁকে গেছে। কিন্তু ট্রেকে অসুবিধে হল এখানেই চলাটাই মুখ্য। বাকি সব গৌণ। ছবি তোলা, ভাবনা, খোঁজা এসব নিয়ে কারো মাথাব্যথা নেই। নিরাপদে পরবর্তী গন্তব্যে পৌঁছে দেয়াই সবার উদ্দেশ্য। তাই যেতে যেতে যা চোখে পরে তাই মোবাইলে তুলে রাখি।

রোমান শিরস্ত্রাণ।

  কোনোটিকে দেখতে রোমান শিরস্ত্রাণের মত, কোনোটি বাঘের মুখ, কোনোটি লাফিং বুদ্ধা তো কোনোটি বিষণ্ণ যুবক। কোনোটি নারীর বিপুল স্তন তো কোনোটি তার যোনি। যোনি বা লিঙ্গের মত আকৃতির বিপুল পাথর খুঁজছিলাম। চোখে পড়ল না। না দেখে হতাশই হলাম। হিমালয়ে আছি অথচ লিঙ্গের আকৃতির পাথর চোখে পড়ে নি এটা প্রায় অবিশ্বাস্য। রাতে যখন শুয়ে ঘুমিয়েছি স্বপ্ন অধ্যুষিত নিদ্রায় এক নারী এলেন। মধ্যবয়স্কা। আমাকে দেখে আমাকে ডেকে এক আলাদা স্থানে নিয়ে গিয়ে তার বিপুলাকৃতি যোনি দেখালেন। ধীরে ধীরে তার যোনি তার দেহের আকৃতিকেও ছাপিয়ে উঠল। নারীটিকে মনে হল আমি কোথাও দেখেছি। গায়ের রং শ্যামলা। ছোট করে কাটা চুল। পঞ্চাশের মত বয়স। আমি বুঝতে পারলাম না এটা আমার অবদমিত কামনা নাকি হিমালয়ে আসায় আমার মনে ইয়ুং কথিত আর্কিটাইপ দেবী মিথের সাথে এভাবেই জড়িয়ে গেছে। তাই হয়ত চারিদিকে এত মাতৃমন্দির। কদিন বাদেই দেখব যমুনোত্রী ধামে মা যমুনাকে দেখার জন্য অগণিত মানুষের ঢল। আমার হৃদয়ে ভক্তি নেই। শুধু কামনা আছে। মা জানেন আমি তার দর্শনে যাব না। তবু কাছে তো এসেছি। তার যোনি খুঁজছি পাথরের ভাস্কর্যে। তাই তিনিই কি এলেন আমার স্বপ্নে?

বিষণ্ণ মূকাভিনয় অভিনেতা।

  সামনের দিকের গোটা রাস্তা ধরেই সামনে উন্মুক্ত পাহাড়ের চূড়া। সৌমিক তার মোবাইলের অ্যাপ ‘পিক ফাইন্ডার’ দিয়ে দেখছে সেগুলো বান্দরপুছ ওয়ান আর কালানাগ বা ব্ল্যাক পিক। যদিও দীপক বলছিল ব্ল্যাক পিক বলে যাকে দেখাচ্ছে তার সন্দেহ আছে সেটি আদপে সত্যি কিনা। কিন্তু রোদ এত কড়া যে বরফাবৃত পাহাড়ের ছবি তোলা খুব কঠিন। এত বেশি এক্সপোজার যে ছবি জ্বলে যাছে। যাই হোক কিছু করার নেই দেখে মোবাইলেই তুললাম। আর সবসময় দাঁড়িয়ে ক্যামেরা বের করে ছবি তোলাও সহজ নয়। অগত্যা মোবাইলই গতি।

এই পথেই বারবার ফিরে আসা।

  উল্টোদিকের পাহাড়ে ম্যাপল, ওক আর সিলভার ফারের বন ধাপে ধাপে উঠে গথিক ভাস্কর্য তৈরি করেছে। আমার পাহাড়ের এই পাইন ফার ওকের চূড়া দেখে মনে হয় এদের দেখেই হয়ত মানুষের মনে গির্জার চূড়াকে গথিক ভাস্কর্যে রূপান্তরিত করার কথা প্রথম মনে হয়েছিল। আমরা যা কিছু দৃশ্য দেখি তা তো সবই প্রকৃতি থেকেই নেওয়া। প্রকৃতির মূর্ত রূপ আমাদের কল্পনায় বিমূর্ত হয়ে ওঠে। যোনির ভাবনা যেমন আমার পরাবাস্তব মনের গভীরে গিয়ে এক যোনিসর্বস্ব নারী হয়ে উঠেছে। আমি তো দালি নই। আমার জায়গায় উনি থাকলে উনি সেই পরাবাস্তবতার নারীকে হয়ত অসাধারণভাবে ফুটিয়ে তুলতেন। আমি আমার অক্ষম ভাষায় তাকে প্রকাশ করার চেষ্টা করলাম মাত্র।

  কিছুদূর যাবার পরেই পড়ল রেনবাসেরা। এখানে একটা ছোট বাসস্টপের মত ছাউনি আছে। অনেকে নদীর ধারে এখানেও ক্যাম্প করে। একটু এগিয়ে পড়ল এক সুন্দর ছোট গুহা। গুহার ভেতরটা পরিচ্ছন্ন। দীপক বলল রাস্তায় বৃষ্টি এসে যাওয়ায় একবার তারা এই গুহার মধ্যে রাত কাটিয়েছিল। এখানে আসার আগে ‘লুনানা- আ ইয়াক ইন দ্য ক্লাসরুম’ এই ভুটানি ছবিটা প্রাইমে দেখে এসেছি। সেখানে লুনানা যাবার পথে ওরা একদিন রাতে এক গুহায় কাটিয়েছিল। গুহাটা দেখে সেই দৃশ্যটার কথাই আমার প্রথমে মনে এল।

এই সেই গুহা।

  রাস্তা জুড়ে অনেক জলপ্রপাত। আর অনেক ছোট পাহাড়ি কাঠের পাটাতন পাতা ব্রিজ। নামেই ব্রিজ। সেগুলো পাহাড়ি সাঁকোও নয়। অনেক জায়গায় ব্রিজ নেই। পাথরের ওপর পা দিয়ে সন্তর্পনে নদী পার হতে হচ্ছে। প্রপাতগুলো যেহেতু পাহাড়ের অনেক ওপর থেকে এসে তামসার সাথে মিশেছে অধিকাংশগুলোই বিরাট উঁচু। আমি তাই তাদের পায়ের সামনে দাঁড়িয়ে ছবি তুলতে গিয়ে বারবার হতাশ হচ্ছি। এত সুন্দর প্রপাতগুলোর ছবি তুলতে হলে উল্টোদিকের পাহাড়ের ঢালে দাঁড়িয়ে ছবি তুলতে হবে। কিন্তু তা তো আর সম্ভব নয়।

গাইড দীপকের সাথে।

  আমাদের সঙ্গে এক নতুন দল চলেছে। তাদের দলে বিদেশিরা আছেন। আছে একটি বাচ্চা ছেলে ও মেয়ে। শুনলাম ওরা আজকে রুইনসারা তালে কাটিয়ে কাল ফিরে আসবে। অনেকেই শুনলাম হানিমুনে রুইনসারা তালে ট্রেক করতে আসে। সে না হয় এল কিন্তু হানিমুনে এসে এই ঠান্ডায় কি করে করে কে জানে? খুব লম্বা চওড়া চেহারার দুটো ছেলে ও একজন মধ্যবয়স্ক লোক ফিরে চলেছে। কাল একটি মেয়েকে দেখেছিলাম পনি করে নামছে। পা ভেঙে গেছে। এদের দেখে মনে আশংকা বেড়ে গেল। এত যুবক সমর্থ ছেলেরা বালি পাস না করতে পেরে ফিরে আসছে, আমার মত হ্যাংলা চেহারার বুড়ো বাঙালি পারবে তো?

ওয়াইল্ড থাইম।

  আকাশে হালকা হালকা মেঘের সঞ্চার হচ্ছে। অনেক্ষণ ধরে হেঁটে চলেছি। হেঁটেই চলেছি। এবার শারীরিক ও মানসিক ক্লান্তি আসতে শুরু করেছে। সাড়ে পাঁচ ঘন্টা পার হয়ে গেছে। ছবিও আর তুলতে ইচ্ছে করছে না। পথের ধারে ফুটে রয়েছে বেগুনি আইরিস, হলুদ, লাল, সাদা নানা রঙের বুনো ফুল। এদের নিশ্চই কিছু নাম আছে। গাইডরা কেউ জানে না কিন্তু কিছু নিশ্চই আছে। অনেক ভূর্জপত্র গাছের সারি শুরু হয়ে গেল। কত যুগ থেকে মানুষ এদের গায়ের ছাল দিয়ে কাগজ বানিয়ে লিখেছে। কোনো একদিন এমনই এক বর্ষাবকাশে এক কবি পাহাড়ে মেঘের অবয়ব দেখে মন্দাক্রান্তা ছন্দে এক বিরহী যক্ষের কথা লিখে অমর হয়ে গেছেন। আমিও তো লিখছি প্রেমের কথা, কামনার কথা, রূপের কথা। আমার লেখা কি এত যুগ পরে লোকে আর পড়বে?

ভূর্জপত্র বা হিমালয়ান বার্চ।

  অবশেষে শেষ চরাই পার হয়ে আমরা দেখলাম শেষ বড় কাঠের সাঁকো দেখা যাচ্ছে। তার সাথেই দেখা যাচ্ছে আমাদের লাল তাবু। বুঝলাম রুইনসারা তালে পৌঁছে গেছি। ব্যাগ রাখতেই খাবার ডাক পড়ল। দুপুর দুটো বাজে। ছ’ঘন্টা হেঁটেছি। মেনু ভাত ডাল পাঁপড়। খেয়ে দেয়ে পা ছড়িয়ে বসলাম। খেরাজ বলে রাজস্থানের এক ছেলে যে কোল ইন্ডিয়ায় বাংলায় চাকরি করে ওই আমাদের দলে যাকে বলে সবচেয়ে চাঙ্গা। ও একটা বল এনেছে। সবাই তাই দিয়ে খেলছিল। কী করে খেলে কে জানে? আর হাই অল্টিটিউডে খেলাধুলা একদম না করাই উচিত। ভাবলাম কাল বলব। তবে ওদের ফূর্তি দেখে আমি বুঝছিলাম আমার বয়স হয়েছে। যতই হোক দলের সবচেয়ে সিনিওরি বলে কথা।

পাখির চোখে আমাদের ক্যাম্প। সামনেই কাঠের ব্রিজ।

  বিকেলে জলখাবার এল ফুচকা বা গোলগাপ্পা। সঙ্গে পুদিনার জল। কোনো কথা হবে? দেবার সাথে সাথে হাওয়া। তবে লক্ষ্য করলাম অনেকেরই পেটের সমস্যা হচ্ছে। দ্বিতীয়বার দেবার পর অনেক ফুচকা পড়ে রইল। ওরা কিচেনে ফিরিয়ে নিয়ে গেল। আমাদের যেখানে ক্যাম্প হয়েছে রুইনসারা তালে যেতে হলে অনেকটা ওপরে চড়তে হবে। বিকেলে হাঁটতে গিয়ে আমরা সেখানে গেলাম। আমার যাবার খুব ইচ্ছে করছিল না। শুধু ছবি তুলব বলে গেলাম। স্লিপার পায়ে দিয়েই বেরিয়ে পড়ায় পাহাড়ে উঠতে অসুবিধে হচ্ছিল।

আমাদের ক্যাম্প।

  রুইনসারা তাল বা হ্রদটি সম্ভবত হিমবাহ গলে তৈরি হয়েছে। দূরে যে বান্দরপুছ পর্বত দেখা যাচ্ছে এদের হিমবাহ থেকেই কোনো একদিন হয়ত এই তাল তৈরি হয়েছে। এখন হিমবাহ সরে গেছে। গোয়েচালার বিখ্যাত সমিতি লেক থেকে প্রেকছু নদীর সৃষ্টি হয়েছে। কিন্তু এই লেক থেকে কোনো নদীর উৎপত্তি হয় নি। এটা চারদিক দিয়ে বদ্ধ। শীতকালের বরফ গলে বা বৃষ্টির জলে সম্ভবত এই লেকের জল সারাবছর থাকে। লেকের চারদিকে হালকা সবুজ ঘাসের বুগিয়াল। মাঝে মাঝে পাথর মাথা উঁচু করে আছে। একটি ছোট্ট শিবমন্দির। পাথরের ওপরে।

রুইনসারা তাল।

  সবাই রুইনসারার চারিদিকে বুগিয়ালে ঘুরে বেড়াচ্ছে। পাথর দিয়ে কেয়ার্ন্স বানিয়ে ছবি তুলছে। আমি স্লিপার পরে এসেছি। স্লিপার পায়ে পাথর ভেঙে আর নামার ইচ্ছে হল না। পাথরের ওপরে বসে দেখলাম তালের অন্যদিকে অপর দলটি তাবু করেছে। কাল ওরা এখান থেকেই সাঁকরির উদ্দেশ্যে রওনা হবে। আজ তাই ওদের কষ্টের প্রায় শেষ। রুইনসারার খোলা প্রান্তরে ওদের মনে প্রবল আনন্দ। ওদের দলের একটি মেয়ে গাইডের হাত ধরে হাসতে হাসতে তালের অনেক পেছনে পাথরের দিকে চলে গেল। দুজনেই যৌবনের ছোঁয়ায় বেহুঁশ। কেদারনাথ সিনেমার প্রভাব অনেকের ওপরেই পড়েছে। যমুনোত্রী যাবার রাস্তায় তো দেখব সব গাইডদের মোবাইলেই গান বাজছে ‘নমো নমো জি শঙ্করা…’। আমাদের এই শঙ্কর-শঙ্করীর ভাগ্যে কী আছে কে জানে?

রুইনসারা তালের ছোট্ট শিবমন্দির।

  দুন স্কুলের শিক্ষক জ্যাক গিবসনের নামে এই রুইনসারা তালটি জনপ্রিয় হয়েছিল। তিনিই প্রথম তেনজিং নোরগের সাথে বান্দরপুছ রিজ সামিট করেন ১৯৩৭ সালে। তারা এই রুইনসারার ধারে ক্যাম্প করেছিলেন। সেই স্কুল শিক্ষক সারা পৃথিবীতে এই তালকে পরিচিত করান। তেঞ্জিং ও নাকি তার সব লেখায় গিবসনকে ‘আমার প্রিয় বন্ধু’ বলে সম্বোধন করতেন। তেঞ্জিং-এর ভবিষ্যৎ জীবন তো একদিন সম্পূর্ন বদলে যাবে আর ১৬ বছর পরে মে মাসের ২৯ তারিখে। আজ জুন মাসের ১। আজ আমি যেখানে বসে আছি একদিন তেঞ্জিং ও তার প্রিয় বন্ধু গিবসন হয়ত এখানে বসে বসেই বান্দরপুছের দিকে তাকিয়েছিলেন। পরিকল্পনা করছিলেন কিভাবে রিজ ক্লাইম্ব করবেন। তখনও হয়ত এমনি বিকেল ছিল। রুইনসারার জলে বান্দরপুছের ছায়া পড়েছিল। শুধু তখন আরো নীরবতা ছিল। এক ব্রিটিশ রক্তে পৃথিবীর যে কোনো অচেনাকে চিনে নেবার অদম্য বাসনা ছিল। আরেকজনের চোখে অন্য কিছু ছিল। অন্য স্বপ্ন। কিন্তু তা যে কোনোদিন সত্যি হয়ে উঠবে সেটা ভাবার মত কল্পনার জোর সেই নেপালি শেরপার ছিল না।

  ক্যাম্পে ফিরে এসে শুনলাম আমাদের দলে নাগেশ্বর ও রাহুল নামে দুজন অসুস্থ হয়ে পড়েছে। নাগেশ্বর নিয়মিত ম্যারাথন রানার ব্যাঙ্গালোরের। রাহুল আবার ট্রায়াথলন আয়রন ম্যান প্রতিযোগিতায় সুইডেনে ভারতের হয়ে প্রতিনিধিত্ব করে এসেছে। কেরালার ছেলে। ছিপছিপে লম্বা স্মার্ট। আমি ফিরে আসার পর অনেক্ষণ আমার সাথে কথা বলল। ওর বমি হয়েছে। স্যাচুরেশন কমে যাছে। হাঁপিয়ে যাচ্ছে। ওকে বোঝালাম ও হয়ত পারবে না। কারণ আমাদের কাল থেকে আরো কঠিন রাস্তা শুরু হবে। আর আজকের পর পনিরাও আমাদের ছেড়ে চলে যাবে। সাঁকরি ফেরা তখন কঠিন হয়ে পড়বে। যা সিদ্ধান্ত নেবার ওকে আজকেই নিতে হবে।

  এত ফিট একটা ছেলে অথচ পাহাড়ের কাছে এসে কেমন কাবু হয়ে পড়েছে। আসলে গত সাত বছর ও কোনো ট্রেক করে নি। ট্রেকের ধারাবাহিকতা একটা বিরাট ব্যাপার। কিসে কী হয়েছে কে জানে? মনে হল ওরা দু’জন কাল সকালে ফিরে যাবে। ওদের মন ভেঙে গেছে। মহাবীর ঝুঁকি নেবার লোক না।

  রাতের মেনু ভাত ডাল রুটি বেগুনের তরকারি আর শাহী টুকরা। খাওয়া কাল থেকেই কমিয়ে দিয়েছি। একটা রুটি আর অল্প ভাত খেলাম। শাহী টুকরা মিষ্টিটা এই প্রথম খেলাম। পাউরুটি দিয়ে বানায়। দিল্লিতে নাকি খুব জনপ্রিয়। বেশ লাগল খেতে। রাতে শুতে যাবার সময় দেখলাম চাঁদের আলোয় বান্দরপুছ রেঞ্জ দেখা যাচ্ছে। কালকে যাবার পথের দিকে তাকালাম। কাল থেকেই আসল পরীক্ষা শুরু হবে। এতদিন তো শুধু গা গরম ছিল। দীর্ঘশ্বাস নিয়ে স্লিপিং ব্যাগের চেন বন্ধ করে দিলাম।

(৫)

  পাহাড় মানেই মুনিঋষিদের তপস্যা করার ভূমি। দেবভূমি। এইখানে রামায়ণের যুগেও তারা তপস্যা করতেন। ওডারি নামে এক রাক্ষস তাদের তপস্যায় খুবই বিঘ্ন সৃষ্টি করছিল। মুনিরা অনুরোধ করায় বালি আর সুগ্রীব দুই ভাই তাই রওনা হল ওডারিকে বধ করবে বলে। ওডারি থাকে পাহাড়ের এক গুহায়। বালি সুগ্রীবকে বলল, সে ভেতরে যাচ্ছে ওডারিকে বধ করতে। ভাই যেন গুহার মুখের কাছে অপেক্ষা করে।

  এদিকে একদিন দু’দিন তিনদিন সাতদিন পার হয়ে গেল দাদা আর আসে না। সুগ্রীব ভাবল দাদা বোধহয় যুদ্ধে মারা গেছে। সুগ্রীব তাই গুহার মুখটা এক পাথর দিয়ে বন্ধ করে রাজ্যে ফিরে এল। এদিকে বালি ওডারিকে বধ করে দেখে গুহার মুখ বন্ধ। তাই অন্যদিক দিয়ে ঘুরে বের হয়ে পাহাড়ি পাস পার হয়ে নিজের রাজ্যে ফিরে এল। তখন থেকে এই গুহার মুখ বন্ধ। আপনি সত্যিই গুহার সামনে দাঁড়ালে মনে হবে গুহার মুখটা যেন কেউ বন্ধ করে দিয়েছে। সেই থেকে ওই পাহাড়ি এলাকার নাম ওডারি। আর যে পাস বালি অতিক্রম করেছিল তার নাম বালি পাস।

এই সেই গুহার মুখ।

  এই ঘটনার পর থেকেই নাকি বালি আর সুগ্রীবের মধ্যে মতবিরোধ শুরু হয়। দাদা রাজ্যে ফিরে এসে ভাইকে কী ঝাড়টাই না ঝেড়েছিলেন একবার খালি ভেবে দেখুন! যদিও গাড়োয়ালি ভাষায় ‘ওডারি’ কথার অর্থ গুহা। যাই হোক ওডারি নামের রাক্ষসই হোক বা ওডারির অর্থ গুহাই হোক এখানে একটি গুহার অনুরূপ পাহাড়ি অংশ আছে। তাই ওই জায়গার নাম ওডারি।

  আজ আমরা রুইনসারা তাল থেকে ওডারি যাব। ৪ কিমি রাস্তা। ১,৮০০ ফুট উঠতে হবে। তাই ধীরে ধীরে যাব। আজ আমাদের তাড়া কিছু নেই। সকালে শুনলাম রাহুল আর নাগু আজ ফিরে যাবে নীচে। আজ পনির সাথে যাবে দেবসু। কাল দেবসু থেকে সাঁকরি। ওদের জন্য খারাপ লাগছিল। খালি ভাবছিলাম ওদের জায়গায় আজকে আমি থাকলে? রাহুলের স্যাচুরেশন ৬৭, নাগেশ্বরের পেট খারাপ কমে নি। জ্বর আসছে। আজ থেকে পনিরা আর আমাদের সাথে থাকবে না। তাই এর পরে ফিরে যাওয়া কঠিন।

ওডারির পথে।

  সকালের জলখাবার দুধ, কর্নফ্লেক্স আর আলু পরোটা। খাওয়াদাওয়ার পরে আমরা সাড়ে নটায় ওডারির দিকে হাঁটা শুরু করলাম। জঙ্গলের মধ্যে দিয়ে কিছুদূর ওঠার পরই লক্ষ্য করলাম গাছপালা সব শেষ হয়ে এল। কিছু রডোডেন্ড্রন গাছ দেখা যাচ্ছিল। তাদের গোলাপি ফুল প্রায় শুকিয়ে এসেছে। আজ জুনের দুই। মার্চ এপ্রিলেই এদের ফোটার সময়। এখন অসময়ের কিছু ফুল। ঝরে পড়ার অপেক্ষায় ফুটে আছে।

শুকিয়ে আসা রডোডেন্ড্রন।

  হাঁটছি আর বসছি। গালগল্প করছি। আমাদের পায়ের নীচের ঘন সবুজ প্রান্তর আস্তে আস্তে শেষ হয়ে আসছে। নদী হারিয়ে যাচ্ছে। আর আমরা ধীরে ধীরে রুক্ষ পাহাড়ি প্রান্তরের মোরেন ঢাকা এক প্রাণহীন অঞ্চলে প্রবেশ করতে চলেছি। যত ওপরে উঠছি তত আমাদের সামনে স্পষ্ট হয়ে উঠছে স্বর্গারোহিণীর চূড়া। স্বর্গারোহিণী ২ আর ৩ দেখা যাচ্ছে। এক নম্বর চূড়া কিছুটা পেছনে, আমাদের দৃষ্টিপথের বাইরে।

  রঙিন ফুলে ঢাকা উপত্যকা শেষ হয়ে এল। পথে বেগুনি রঙের আইরিস পড়ল। আইরিস প্লেইনফোলিয়া খুব সুন্দর ফুল। একসাথে অনেক ফুটে থাকলে পথের ধারে একটা রাজকীয় বিভা তৈরি হয়। অনেকগুলো ছোট ছোট ক্যালথা পাথরের পায়ের কাছে ফুটে আছে। টকটকে লাল আর হলুদ রঙের পোটেনশিলা উজ্জ্বল আলোয় ঝকঝক করছে। ছোট্ট সূর্যমুখীর মত দেখতে অ্যাল্পাইন অ্যাস্টর। আইরিসের বেগুনি রঙের মতো আরেক অপূর্ব ফুল জেরানিয়াম। মাঝে মাঝে সবুজ ঘাসের উপত্যকায় মায়ার মত ফুটে আছে।

আইরিস প্লেইনফোলিয়া।

  যদিও এই অঞ্চলে ফুল বিক্ষিপ্ত। ভ্যালি অফ ফ্লাওয়ার্সের মত এখানে ফুলের অত আভিজাত্য নেই। গাছপালা শেষ হয়ে যাওয়ায় উঠতে গেলেই দমের কষ্ট হচ্ছে। ধীরে ধীরে উঠছি। একটা বিস্তীর্ণ সবুজ অঞ্চল যা আমরা এই কয়েকদিনে উঠে এসেছি আমাদের পায়ের কাছে একটা অস্পষ্ট খাঁজ হয়ে দাঁড়িয়ে আছে। ফেলে আসা অঞ্চলটা একটা স্নিগ্ধ নীরবতা নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে। বাতাস ছাড়া আর কোনো কিছুরই শব্দ নেই। এই এলাকায় কথা বলতেও মন চায় না। চোখ শুধু অফুরান রূপের পসরা বিনা ক্লান্তিতে দেখেই যায়। এক সময় সেই সবুজের জাদুও ম্লান হয়ে এল। মায়াবী রূপ থেকে এল রুদ্র। বুঝতে পারছি আগামি দু’দিন এক কঠিন পরীক্ষা আমাদের জন্য অপেক্ষা করে আছে।

অ্যালপাইন অ্যাস্টর।

  চার ঘন্টা চলার পর আমরা ওডারিতে এসে পৌঁছুলাম। আপাত এক সমতলভূমি। চারিদিকে মোরেন ঢাকা। হিমবাহ চলে যাবার পর তার প্রবল চাপে সে যে পাথর ভেঙে তার সঙ্গে নিয়ে যায় তাদের কিছু পড়ে থেকে এই মোরেন তৈরি করে। এখানে জলের খুব অভাব। একটা ছোট্ট জলের ধারা তাতে একটা বোতল লাগানো। আমরা তাতেই আমাদের জলের বোতলগুলো ভর্তি করে নিলাম।

আমাদের ক্যাম্প।

  মাথার ওপর প্রচন্ড রোদ। দিনের বেলা তাবুতে ঢোকা বারণ। তাই বাইরে পাতা চেয়ারে বসে জুতো খুলে রোদে পা সেঁকে নিচ্ছিলাম। এই ভর দুপুরেও যথেষ্ট ঠান্ডা। তার সাথে ওডারিতে চলে প্রবল হাওয়া। সেই বরফভেজা হাওয়ায় আরো ঠান্ডা লাগে। খেরাজ, শীল, অমেয়, সৌমিক, মধু ডাইনিং টেন্টের ভেতর বসে কল ব্রিজ খেলছে। আমি আর অন্বয় ওদের পাশে বসে খেলা দেখছি। বাইরে যা ঠান্ডা টেন্টের ভেতর থাকলে কিছুটা আরাম হয়। দিনের রোদ টেন্টের ভেতর একটা গরম ভাপ তৈরি করে যাতে শরীরে আরাম লাগে। তার সাথে নিদ্রাজড়তাও এসে যায়। ওটাকে কাটাতে মাঝেমাঝেই বাইরে গিয়ে ঘুরে আসতে হয়।

  দুপুরে খাওয়ার পরে টেন্টে সবাই বসে নানান পাহাড়ি গল্প হচ্ছে। মহাবীর খুব সুন্দর করে গল্প করে। দীপকের কথা দুম করে শেষ হয়ে যায়। নিজের ভাষা প্রকাশ করার ও তাকে দীর্ঘায়িত করার কায়দা তার বেশি জানা নেই। মহাবীর গল্প করছিল ও স্টোক কাংড়ি ট্রেকে চারজন ট্রেকারকে কিভাবে উদ্ধার করেছিল। বেশ কিছু দুর্ঘটনা ঘটার জন্য স্টোক কাংড়ি ট্রেক এখন বন্ধ আছে বলে মনে হয়।

  কথায় কথায় উঠে এল নন্দাদেবী অভিযানের কথা। মহাবীর আমাদের বলল, আপনারা জানেন কেন নন্দাদেবী অভিযান ভারত সরকার বন্ধ করে রেখেছে? আমি অস্পষ্ট জানতাম। এবার ২০২১ সালের ৭ ফেব্রুয়ারি প্রবল ঠান্ডার সময় অভাবিতভাবে উত্তরাখন্ডের চামোলি জেলায় নন্দাদেবী হিমবাহ ফেটে গিয়ে ঋষিগঙ্গার ওপরে যে প্রচন্ড বন্যা হয় সেসময় নন্দাদেবী নিয়ে ইন্টারনেটে কিছু কিছু কথা উঠে এসেছিল। সেসব নিয়েই আমাদের আলাপ শুরু হল।

  ১৯৬০ সালে চিন ভারত যুদ্ধের পরে ১৯৬৫ সালের অক্টোবর মাসে সি আই এ ও ভারত সরকারের গুপ্তচর সংস্থা আই বি চিনের নিউক্লিয়ার প্রোজেক্টের ওপর নজরদারি করার জন্য হিমালয়ের কোনো এক চূড়ার ওপর একটি নিউক্লিয়ার ডিভাইস বসাবার কথা ভাবেন। প্রথমে ঠিক হয় কাঞ্জনজঙ্ঘার ওপর বসানো হবে। কিন্তু সেটি পুরোপুরি ভারতের মধ্যে নেই। কিছুটা আছে নেপালে। তাই ঠিক হয় ভারতের দ্বিতীয় উচ্চতম পর্বত নন্দাদেবীর ওপরে সেটি লাগানো হবে। এই অভিযানের দায়িত্ব পরে ক্যাপ্টেন মনমোহন সিং কোহলির ওপর। তিনি সবে কিছুদিন আগেই মাউন্ট এভারেস্ট সামিট করে এসেছেন। এই অভিযানের ব্যাপারে সম্পূর্ন গোপনীয়তা বজায় রাখা হয়। কোহলি নিজেও সবটা জানতেন না।

  ঠিক হয়েছিল সাতটা প্লুটোনিয়াম ক্যাপসুল ও একটা গুপ্ত অনুসন্ধানী যন্ত্র নন্দাদেবীর চূড়ায় রেখে আসা হবে। তাদের মিলিত ওজন ছিল প্রায় ৫৭ কেজি।  সামিটের পরেই চূড়ায় আবহাওয়া খুব খারাপ হয়ে যায়। কোহলি তাই তার দলবল নিয়ে তাড়াতাড়ি নীচে নেমে আসেন। পরের বছর  আবার সেখানে যান। কিন্তু চূড়ায় পৌঁছে দেখেন সেই যন্ত্রটি আর সেখানে নেই। হতে পারে প্রবল তুষারঝড়ে সেটি বরফ চাপা পড়ে গেছে। কোহলির মতে সেই প্লুটোনিয়ামের তেজস্ক্রিয়তা প্রায় ১০০ বছর পর্যন্ত থাকতে পারে। গত বছর নন্দাদেবীর গ্লেসিয়ার ফেটে ঋষিগঙ্গায় বিরাট বন্যা হবার পরে অনেকেই ভাবতে থাকেন সেই প্লুটোনিয়াম ক্যাপসুলে হয়ত বিস্ফোরণ হয়েছে।

  সরকার থেকেও তখন ঋষিগঙ্গার জলের নিয়মিত তেজস্ক্রিয়তা পরীক্ষা করা হয় কিন্তু জলের নমুনায় তেমন কিছু পাওয়া যায় নি। কোহলি সেই অভিযানের ওপর একটি বই লেখেন, তার নাম ‘স্পাইস ইন দ্য হিমালয়াস’। সত্যি মিথ্যে কেউ জানে না। আদৌ গত বছর হিমালয়ে সত্যি বিস্ফোরণ ঘটেছিল নাকি ভূমিকম্প? আগামি বছরগুলিতে আবার এমন ঘটার সম্ভবনাই বা কতটা আছে? আমরা কেউ তা জানি না। তবে এসব আলোচনা যখন চলছিল তখন হিমালয়ের রহস্যময়তা অনুভব করে আমার বেশ রোমাঞ্চ হচ্ছিল। কাল ও পরশুর কঠিন পথ চলার উৎকন্ঠা অনেকটাই কেটে গিয়েছিল।

  বনপর্বে আছে যে পান্ডবেরা তীর্থযাত্রায় যাচ্ছেন। লোমশ মুনি এসেছেন তাদের সঙ্গে দেখা করতে। পথ প্রদর্শক হয়ে সাথে যাবেন। মহারাজের লটবহর দেখে মুনির তো চক্ষু চড়কগাছ। এ কী করেছেন রাজন্‌! ‘লঘুর্ভব মহারাজ লঘুঃ স্বৈরং গমিষ্যসি’। সেই অমর বাক্য আজো পাহাড়ের যাত্রীরা বিনা বাক্যে মেনে চলেন। লঘুর্ভব। যতটা কম পারা যায় ততটাই কম জিনিস নিয়ে পাহাড়ে আসুন। আনাতোলি ফ্রাঁস তো এই সেদিন বলেছেন, ‘টু ট্রাভেল মোর ট্রাভেল লাইট’। আমাদের লোমশ মুনি সেই কবে বলে গেছেন। তবু আমাদের ভুল হয়ে যায়। অনেক অদরকারি জিনিস বয়ে নিয়ে চলে আসি। এতদিন বাদে যেন দেখেছি কিছুটা বুঝতে পারি রাকস্যাক কিভাবে গোছাব।

  রাতের খাবার ভাত ডাল রুটি মটরের তরকারি আর গোলাপজামুন। খুবই কম খেলাম। এখানেও সেই মহাভারত। যুধিষ্ঠিরের সাথে কঠিন তীর্থযাত্রায় যেসব ব্রাহ্মণেরা যেতে উৎসুক তাদের তিনি সতর্ক করে দিচ্ছেন। যারা ক্ষুধা, পিপাসা, পথের পরিশ্রম, রোদের তেজ, শীতের কষ্ট সহ্য করতে পারেন না তারা যেন ফিরে যান। আর যেসব ব্রাহ্মণেরা চব্য চোষ্য লেহ্য পেয় ও মাংস ভোজনে পটু তারাও যেন ফিরে যান।

‘তে সর্বে বিনিবর্তন্তাং যে চ মিষ্টভুজো দ্বিজা

পক্বান্নলেহ্যপানানাং মাংসানাঞ্চ বিকল্পকাঃ’।

  আমি শীতকাতুরে বামুন কিন্তু ভোজনে আমার রুচি নেই। তাই ধর্মরাজের কথাটা আমি পাহাড়ে অক্ষরে অক্ষরে মেনে চলি। পেট ঠিক থাকলে পাহাড়ে হাঁটা অনেকটাই সহজ হয়ে যায়। তাই পেটে জায়গা রেখে খাই। ভালোয় ভালোয় আর দুটো দিন পার করে দিলেই এ যাত্রায় রক্ষে। পরের বার দেখা যাবে।

(৬)

  আজ আর কাল আমাদের আসল পরীক্ষা। আমাদের শরীর এই এত দিনে পাহাড়ে হেঁটে, থেকে, কতটা পাহাড়ের সাথে মানিয়ে নিয়েছে এই দু’দিন তারই পরীক্ষা। ৪৫ বছরের জীবনে এই প্রথমবার জন্মদিনে ১৫,২০০ ফুটে বরফের ওপরে বালি কল ক্যাম্পে রাত কাটাব। আমার সামান্য জীবনের এ এক অসামান্য অভিজ্ঞতা হয়ে থাকবে। আমি এটুকুই পারি। এটুকুতেই আমার আনন্দ। এর থেকে বেশি বিরাট কিছু করে দেখানোর তাগিদ আমি ভেতর থেকে অনুভবও করি না। কারণ সে ক্ষমতা আমার নেই।

প্যানোরামা।

  আজ যাচ্ছি বালি কল ক্যাম্পে। ৫ কিমি রাস্তা। ২০০০ ফুটের কিছু বেশি উঠতে হবে। পুরো রাস্তাটাই চরাই আর কঠিন। সাবধানে চলতে হবে। এখন জুনের প্রথমে বরফ যদিও অনেকটাই গলে গেছে কিন্তু তাতে রাস্তার পাথুরেভাব আরো বেড়ে গেছে। এতে চলার কষ্ট বেশি হবে বলেই মনে হয়। ‘কল’ শব্দের অর্থ দুটো পাহাড়ের মধ্যেকার নিচু জায়গা, বা দুটো চূড়ার মধ্যেকার নিচু জায়গা। আমরা যে বালি কল যাচ্ছি সেটি আসলে বালি পাসের আগে এক ছোট সমতল এলাকা যেখানে সবাই ক্যাম্প করে। আর ‘পাস’ বলতে সাধারণভাবে বোঝায় সরু পথ যা কিনা দুটো পাহাড়ি উপত্যকাকে যুক্ত করে। বালি পাস হর কি দুন ভ্যালি আর যমুনোত্রী অববাহিকাকে যুক্ত করে।

চলার পথের বিশ্রাম।

  আটটার মধ্যে জলখাবার খেয়ে আমরা রওনা হলাম। ঘুরে ঘুরে পাথুরে পথ পেরিয়ে অনেকটা ওপরে উঠে প্রথম বার বিশ্রাম নিলাম। সঙ্গে দুই লিটার জল আছে। এই জলই আজকের সম্বল। রাস্তায় আর কোথাও জল পাওয়া যাবে না। তাই তৃষ্ণায় গলা ফেটে গেলেও গলা ভেজানো ছাড়া উপায় নেই। ওপরে উঠে যেখানে এসে বসলাম নীচে তাকিয়ে অনেক নীচে ওডারির ক্যাম্প দেখতে পাচ্ছি। দূরে বিরাট প্যানোরামায় দেখা যাচ্ছে স্বর্গারোহিণীর চূড়া। স্বর্গারোহিণী ২ ও ৩। পেছনে ১।

স্বর্গারোহিণী ১ ও ২

  এই সেই স্বর্গারোহিণী যাকে আরোহণ করে পান্ডবেরা স্বর্গে গেছিলেন। পান্ডবেরা কোন পথ দিয়ে স্বর্গে গেছিলেন তা নিয়ে মতভেদ আছে। তবে বেশিরভাগ পন্ডিত যেটা বলেন পান্ডবেরা বদ্রীকাশ্রম বা বদ্রীনাথ ধাম হয়ে গিয়েছিলেন। কেউ আবার বলেন কেদারনাথ হয়ে গিয়েছিলেন। দীপক বলছিল গাড়োয়ালিরা মনে করে যে কেদারনাথ আর বদ্রীনাথ দুটো মন্দিরই নাকি পান্ডবেরা নির্মাণ করেছিলেন। আসলে কেদারনাথ আর বদ্রীনাথের মধ্যে ব্যবধান বেশি নয়। ৬ মাইলের মত। এখন তাদের আলাদা করে রেখেছে এক বিরাট তুষারের প্রাচীর। কিন্তু পান্ডবদের সময় বা তার পরেও সেখানে সেই প্রাচীর ছিল না।

  কথিত আছে এক ব্রাহ্মণ বদ্রীনাথে পুজো দিয়ে আবার হেঁটে যেতেন কেদারনাথে পুজো দিতে। একদিন খিদে পাওয়ায় পথে বদ্রীনাথের পুজার নৈবেদ্য আহার করে তিনি কেদারনাথে পুজো করেন। ব্রাহ্মণের সেই পাপেই নাকি দুই ধামের মধ্যে তুষার প্রাচীর উঠে যায়। অন্য এক জনশ্রুতি বলে ব্রাহ্মণ নাকি পুজো দিয়ে বাড়িতে ফিরে ব্রাহ্মণীকে রোজ ঠ্যাঙ্গাতেন। ‘আমি দুই মন্দিরে পুজো দিয়ে ফিরলাম। আর তোর এখনো রান্না হয় নি!’ চালাক ব্রাহ্মণী তাই নাকি মহাদেবের কাছে অনুযোগ করেন স্ত্রীকে নির্যাতনের অপরাধে ব্রাহ্মণ যে পাপ করছেন তাতে পুজোর মাহাত্ম্য নষ্ট হবে। মহাদেব তাই তখন দুই মন্দিরের মধ্যে প্রাচীর তুলে দেন। এ সবই জনশ্রুতি। তবে এখানে এলে এগুলোকে মিথ্যে মনে হয় না। দেবভূমির এটাই লীলা।

  বদ্রীকাশ্রম হয়ে মানাগ্রাম হয়ে মানা পাস পার হয়ে পান্ডবেরা অলকানন্দার ধার ধরে স্বর্গারোহিণীর দিকে গিয়েছিলেন মনে করা হয়। এই মানা গ্রামের লোকেরা আগে গরমে তীব্বতের সাথে এই মানাপাস দিয়ে বাণিজ্য করত। শীতে নীচে নেমে আসত। এই গ্রাম চীন ভারতের মধ্যে শেষ গ্রাম। এখন দুই পারেই প্রহরা। আগে এই পথ দিয়ে তীব্বতও যাওয়া যেত। খুব ইচ্ছে একবার মানা গ্রাম যাব। ম্যাপে উত্তরাখন্ডের উত্তরপূর্বের প্রান্তিক গ্রাম এই মানা। এই মানাগ্রামের লোকেরাই নাকি গন্ধর্ব জাতি। এখানে লোকেরা বলে ‘মার্চা’। এদেরই রাজা ছিল কুবের। এদের যক্ষের কাহিনী নিয়েই কালিদাস লিখে গেছেন মেঘদূত।

  অলকানন্দা যেখানে সরস্বতীর সাথে মিশেছে তাকে ছাড়িয়ে লক্ষ্মীবন ও শতপন্থ তাল পার হয়ে অনেক কষ্ট সহ্য করে স্বর্গারোহণের পথ। আগে যারা এই পথে যেত আর ফিরে আসত না। তাই এই পথে তীর্থে যেতে হলে টেহরীর রাজার অনুমোদন নিতে হত। উমাপ্রসাদ লিখেছেন যারা এই তীর্থে আগে যেতে চাইতেন তাদের গৃহত্যাগ করে ১২ বছর বাণপ্রস্থ, সন্ন্যাস এসব করে চরুপাক (বৈদিক যুগের পায়সান্ন) খেয়ে কাটাতে হত। তারপর রাজার কাছে আবেদন করলে রাজা তাদের মাস তিনেক নিজের কাছে রেখে নানান রাজকীয় খাবারদাবার খাইয়ে দাসীদের দিয়ে সেবা(?) করাতেন। তারপর সেই পরীক্ষায় পাস করলে মানে কোনো বিকার না জন্মালে অনুমতি দেওয়া হত। তারা তারপর নগ্ন হয়ে রওনা দিতেন। খুব স্বাভাবিকভাবেই সেই বিপদসঙ্কুল পথ পার হয়ে আর কেউ ফিরে আসতেন না। সত্যিকারের মহাপ্রস্থান হত।

  স্বর্গারোহিণীর দিকে চেয়ে এসব কথাই ভাবছিলাম। সবার আগে পড়ে গেলেন কৃষ্ণা। ‘যাজ্ঞসেনী ভ্রষ্টযোগা নিপপাত মহীতলে’। মহারাজ যুধিষ্ঠির তার দিকে ফিরেও তাকালেন না। একে একে সব ভাইরাও পড়ে গেলে তিনি একাই কুকুরটিকে নিয়ে এগিয়ে চললেন। আমাদের সঙ্গেও চলেছে হিমালয়ান ম্যাস্টিফ। তবে একটি নয়। দুটি। তারা সারাটা পথ জুড়েই প্রেম-ভালোবাসায় মগ্ন। একেই বলে কলির ধারা। স্বর্গারোহিণীর প্রান্তে যখন ধর্মরাজ এসে উপস্থিত তখন ইন্দ্র রথ নিয়ে হাজির। কিন্তু রথে ওঠার আগে অপবিত্র কুকুরটিকে ত্যাগ করতে হবে। ‘ত্যজ শ্বানং নাত্র নৃশংসমস্তি’। ধর্মরাজ এককাট্টা। তিনি তাকে ত্যাগ করে স্বর্গে যাবেন না। এই গল্প তো সবাই শুনেছি। শেরু আর বাঘুর দিকে তাকালাম। এই ঠান্ডায় ওদের কোনো হেলদোল নেই। পায়ের কাছে শুয়ে কুঁইকুঁই করছে। সেই মহাভারতের যুগ থেকে তাহলে কুকুর মানুষের পাহাড়ি পথের যাত্রী। আজও তাই।

নর্ম্যা ক্যান্ডি।

  সামনেই চোখে পড়ছে নর্মা ক্যান্ডি। নোজ রিজ বা র‍্যাজর এজ। খাড়াই সরু রিজ টানা ওপরে উঠে গেছে। নীচে মরণফাঁদ। পা ফসকে পড়লে বাঁচার কোনো সম্ভাবনাই নেই। একদম হাজার ফুট নীচে। তাই সন্তর্পণে পা রেখে চলতে হয়। চলছি তো চলছিই। উঠছি তো উঠছিই। একটু যে দাঁড়াব সেই রকম চওড়া জায়গাও বেশিরভাগ জায়গায় নেই। তাই দাঁড়ানোও একসাথে, চলাও একসাথে। একটা বিশ্রাম নেবার জায়গায় এসে খাদের দিকে তাকালাম। একেই আমার লো প্রেসার। খুব নীচে তাকালে মাথা ঘোরায়। বসে আছি একটা বিপজ্জনক পাথরের ওপর। সরে এসে রিজের ওপর বসলাম। ক্যামেরা বের করে যে ছবি তুলব সেটাতেও উৎসাহ লাগছে না। যেমন ঠান্ডা তেমন ক্লান্তি। আকাশে যদিও মাথার ওপরে সূর্য।

নোজ রিজ।

  রিজের একদিকে বরফ অন্যদিকে পাথর। যেমন হয় পাহাড়ের চূড়ায়। তেমনিই এখানে। স্বর্গারোহিণী যাবার পথেও নাকি এমন এক র‍্যাজর এজ রিজ ধরে চলতে হয়। উমাপ্রসাদবাবু লিখেছেন। গাড়োয়ালের অনেকেই তাই এই পথের সাথে মহাপ্রস্থানের পথের মিল খুঁজে পান। বেশ কিছুদিন আগে এই পথেই নাকি পা পিছলে পড়ে গিয়ে কয়েকজন মারা গেছেন। আমাদের ভাগ্য আবহাওয়া আমাদের সাথে আছে। এই রাস্তায় বৃষ্টি বা তুষারপাত শুরু হলে চলা খুব কঠিন।

রিজের একদিক পাথুরে, অন্যদিকে বরফ।

  নর্মা ক্যান্ডির খতরনাক চরাই যখন শেষ হল, আমরা ওই ১৫,২০০ ফুট উচ্চতায় সবাই তখন প্রায় নিজেদের ক্ষমতার শেষে এসে পৌঁছেছি। আর কিছুটা এসেই চোখে পড়ল আমাদের তাবু। তাবু একদম বরফের ওপর। চারপাশে কেবল সাদা বরফের সাম্রাজ্য। ছোট একটা জলধারা আছে। তবু বরফ গলিয়েই সবাই জল ব্যবহার করছে। জলধারা বরফের অনেকটা নীচে। তার অন্যদিকে টয়লেট টেন্ট। অনেকের বরফ পার হতে গিয়ে পা জলে ডুবে জুতো ভিজে গেল। এখানে জুতো ভিজে গেলে শুকোনো অসম্ভব। ঠান্ডা জুতো পরে থাকলে জ্বর অবধারিত। আমাদের ট্রেক লিডার দীপক ওর জুতো খুলে শীলকে দিল। নিজে ভেজা জুতো পরে থাকবে। পাহাড়ে গিয়ে এই পাহাড়ি মানুষদের সাথে না মিশলে আপনি জানতেও পারবেন না এরা কতটা স্বার্থত্যাগী হয়।

বরফের ওপর আমাদের তাবু।

  আকাশে ঘন মেঘ করে এসেছে। চারিদিকে আলো-আঁধারি। এখানে তো বৃষ্টি হয় না, তুষারপাত হয়। আজ রাতে হলেও হতে পারে। ঠান্ডায় বেশিক্ষণ বাইরে থাকা যাচ্ছে না। আজ তাবুতে যেতে বারণ নেই। তবু নিজের তাবুতে ব্যাগ রেখে কিচেন টেন্টে বসে কল ব্রিজ খেলা দেখছিলাম। আমাদের সঙ্গে আরেক বাঙালি দল চলেছেন। ওনারা এসেছেন বীরভূম থেকে। ওদের তাবু আমাদের সামনেই। আর বিকাটের তাবু পড়েছে খানিকটা দূরে। সামনেই খানিকটা উঁচুতে দেখা যাচ্ছে বালি পাস। মনে হচ্ছে দৌড়ে চলে যাব কিন্তু পাহাড়ে দূরত্বের ভ্রম তৈরি হয়। মহাবীর বলছিল যেতে কম করে দু’ঘন্টা।

আমাদের ট্রেক লিডার মহাবীরের সাথে।

  কাল আমরা সকাল চারটায় বের হব। রাত আড়াইটায় উঠতে হবে। রাত থাকতে থাকতে বের হলে সকালে সূর্যোদয় দেখা যাবে বালি পাসের মাথায়। আজ তাই রাতের ডিনার তাড়াতাড়ি। সন্ধ্যে থাকতে থাকতেই ডিনার খেয়ে নিলাম। ভাত ডাল রুটি সিমাই আর সোয়াবিনের তরকারি। খেয়েদেয়ে তাড়াতাড়ি শুয়ে পড়লাম। সব লেয়ার পরে শুয়েছি। তারপর লাইনার জড়িয়ে স্লিপিং ব্যাগের ভেতর ঢুকেছি। তবু শীত করছে। স্লিপিং ব্যাগের ভেতর ঠকঠক করে কাঁপছি। তাবুর নীচে বরফ। তেড়ে ঠান্ডা উঠছে ওপরে। এত কিছু পরে নড়তেও পারছি না ঠিকভাবে। একবার এপাশ আরেকবার ওপাশ। কিছুতেই ঘুম আসছে না।

  কিছুতেই ঘুম আসছে না। দু’ঘন্টা পার হয়ে গেছে। রাত আড়াইটায় উঠতে হবে। আজ আমার জন্মদিন। খালি বাড়ির কথা মনে হচ্ছে। মেয়ের কথা মনে হচ্ছে। হালকা শ্বাসকষ্ট হচ্ছে। আজ স্যাচুরেশন আশির অনেক নীচে ছিল। আমি ডাক্তার না হলে মহাবীর আমাকে ঠিক নীচে পাঠিয়ে দিত। গা গোলাচ্ছে। বারবার ঈশ্বরের কাছে একটু ঘুমের প্রার্থনা করছি। তবু চোখে এক ফোঁটা ঘুম নেই। সারাদিন চরাই ওঠার জন্য পা কামড়াচ্ছে। কোমর ব্যথা করছে। মাথা এত দপদপ করছে যে মনে হচ্ছে শিরা ফেটে যাবে। জল খেতে গিতে দেখলাম জলের বোতলে জল ঠান্ডায় জমে গেছে। এত কষ্টকর রাত জীবনে এর আগে কাটাই নি।

বরফের সাম্রাজ্য।

  আমি ডাক্তার। মানুষ তার রোগভোগের কষ্ট নিয়ে আমার কাছে আসে। রোগের যন্ত্রণায় মানুষ কিভাবে বিনিদ্র রাত কাটায়, সৈনিকেরা যুদ্ধক্ষেত্রে কিভাবে দিনের পর দিন রাতের পর রাত বিনিদ্র কাটায় সেই কষ্টকে বুঝতে পারছিলাম। আসার আগে ‘হোমল্যান্ড’ দেখছিলাম। সিজন ট্যু অব্দি দেখেছি। নিকোলাস ব্রুডি কারাগারে দীর্ঘ জীবন কাটিয়েছেন ভয়ঙ্কর অত্যাচারে। অভিযাত্রীরা আরো দশ হাজার ফুট বেশি উচ্চতায় রাত কাটিয়ে সামিট করেন। তাদের কষ্টের কাছে এ তো তুচ্ছ। এসব ভেবে মনকে শান্ত করার চেষ্টা করছি। কিছুতেই ঘুম আসছে না। বুঝলাম এতদিন ঠিক থাকলেও আজকে এই বালি কল ক্যাম্পে এসে আমি কিছুটা হলেও এ এম এস এর শিকার হয়েছি। এমনই হয়েছিল আজ থেকে পাঁচ বছর আগে রূপকুন্ড সামিটের আগে বাগুয়াবাসা ক্যাম্পে।

  হালকা শ্বাসকষ্ট হচ্ছে। ভাবছি বাইরে থেকে ঘুরে আসি। যা ঠাণ্ডা উঠতেও জড়তা লাগছে। কেমন যেন একটা অস্পষ্ট মৃত্যুভয় এসময় গ্রাস করে। ‘পাহাড়ের গায়েই যেন আমার মৃত্যু হয়’ এসব কথাকে সমতলের বিলাসিতা বলে মনে হল। যখন বুঝলাম সারারাত আর ঘুম হবে না তখন অপেক্ষা করতে লাগলাম কখন রাত আড়াইটা বাজবে আর বাইরে বেরোবার ডাক আসবে।

  নিজের পঁয়তাল্লিশতম জন্মদিনের রাত যেভাবে কাটালাম জন্মদিন আমার মৃত্যুদিনকেই বারবার স্মরণ করিয়ে দিল।

(৭)

  রাত আড়াইটার সময় যখন টেন্টের বাইরে থেকে চৌকিদারি ডাক এলো তখন জীবনে সম্ভবত প্রথমবার এই প্রবল ঠান্ডায় রাতে উঠে বাইরে বেরোব বলে আমার স্বস্তি হল। আর কিছুতেই শুয়ে থাকতে পারছিলাম না। প্রায় আটঘন্টা নিদ্রাবিহীন ঠান্ডায় কুন্ডলী পাকিয়ে স্লিপিং ব্যাগের ভেতর শুয়ে থাকা যে কী যন্ত্রণার এ অভিজ্ঞতা যার আছে তিনিই জানেন। লেয়ার পরাই ছিল, জুতো পায়ে দিয়ে বাইরে বেরিয়ে এলাম। বাইরে কালো অন্ধকার। আকাশে মিল্কি ওয়ে দেখা যাচ্ছে। খারাপ লাগল এবারের ট্রেকে একটাও রাতের আকাশের ছবি তোলা হয় নি। একদিন যদি বাফার ডে থাকত, অবসর থাকত, তাহলে নিশ্চই চেষ্টা করতাম।

  ব্রেকফার্স্ট এখনই খেয়ে নিতে হবে। ঘোড়ার মত ছোলার তরকারি কিছুটা চেবালাম। আর কিছুই খেলাম না। দুই বোতল গরম জল ভর্তি করে ব্যাগে রাখলাম। পায়ে গেটার আর মাইক্রো স্পাইক পরে নিয়েছি। মাথায় চাপিয়েছি হেলমেট। এ রাস্তায় মাঝেমাঝেই নাকি ওপর থেকে পাথর পরে। চারটের আগেই ব্যাগ নিয়ে তৈরি হয়ে নিলাম। আজকেই আমাদের অভিযান প্রায় শেষ। প্রথম দু’ঘণ্টায় বালি পাস অব্দি ১,০০০ ফুট রাস্তা উঠতে হবে। চলতে হবে প্রায় ২ কিমি। তারপর ১৬,২০০ ফুটের বালি পাস থেকে নামতে হবে লোয়ার ধামিনিতে। যার উচ্চতা ১১,১০০ ফুট। মানে আজ সারাদিনে ১,০০০ ফুট উঠে নামতে হবে ৫,১০০ ফুট! সারাদিনে চলতে হবে প্রায় ১৪ কিমি রাস্তা। ১০ থেকে ১১ ঘন্টা তো লাগবেই। আমাদের পক্ষে সাঙ্ঘাতিক একটা কষ্টকর ব্যাপার। যদিও এমন পথ এর আগেও চলেছি। তাই মনকে সান্ত্বনা দিলাম এই বলে যে, পথ চলার কষ্ট আজই প্রায় শেষ হতে চলেছে।

বালি পাস থেকে অন্যদের দেখাচ্ছে পিঁপড়ের মতো।

  মাথায় হেড টর্চ জ্বালিয়ে ঘন্টাখানেক চলার পরেই দেখলাম আকাশে আলো ফুটে উঠছে। ভোরের সেই আলো-আঁধারিতেই চারিদিকে এমন এক মায়াবি দৃশ্যমানতা তৈরি হয় যে চারপাশটাকে দেখার পক্ষে যথেষ্ট। তাই মাথার টর্চ বন্ধ করে দিলাম। অনেক পেছনে লক্ষ্য করলাম অন্য দুটি দলও রওনা হয়েছে। তাদের কালো কালো পিঁপড়ের মত মূর্তিগুলো দেখতে পাচ্ছি। বরফের ওপর দিয়ে হাঁটতে হাঁটতে শেষ চরাইয়ের সামনে এসে পড়লাম। পাথুরে পথ ভারী শ্বাস নিতে নিতে পার হয়ে আমরা বালি পাসের মাথায় চলে এলাম।

  এই আমাদের লক্ষ্য। এই আমাদের শিখর। এতদিন পর্যন্ত যত ট্রেক করেছি এটাই সবচেয়ে উঁচু। এই প্রথম ১৬,০০০ ফুট অতিক্রম করলাম। সবাই তাই উচ্ছ্বসিত। কিন্তু এখানে বেশিক্ষণ থাকা যাবে না কারণ বালি পাসের স্থান খুব সংকীর্ণ। আমাদের পেছনে আরো দুটো ছোট ছোট দল আসছে। সবাই একসাথে এসে পড়লে পাসে দাঁড়াবার জায়গা পাওয়া যাবে না। আর এই উচ্চতায় বেশিক্ষণ থাকাও কঠিন। যথেষ্ট ঠান্ডা আর পাগল হাওয়া।

  এদিকে বালি পাস থেকে দেখলাম দূরে পাহাড়ের মাথায় সূর্য উঠছে। কিন্তু গোয়েচালার সূর্যোদয়ের সাথে এর কোনো তুলনাই নেই। গোয়েচালায় সূর্য ওঠে আপনার পেছন থেকে তাই ভোরাই আলোয় স্বর্গীয় বিভা তৈরি হয়। এখানে সূর্য আপনার সামনে। তাই ক্যামেরা রাখলেই ছবি জ্বলে যাচ্ছে। বেশিক্ষণ তাকানোও কঠিন। চারিদিকে স্বর্গারোহিণী, বান্দরপুছ আর অন্যান্য গাড়োয়ালি পাহাড়ের চূড়া দেখা যাচ্ছে। আমাদের ঠিক পেছনেই পাতালে দেখা যাচ্ছে যমুনোত্রী উপত্যকা। আমরা এবার নেমে যাব সেই যমুনোত্রী উপত্যকার দিকে।

শিখর ছুঁয়ে।

  বালি পাসের মাথায় একটা ছোট পাথর দিয়ে শিবের লিঙ্গ আর ত্রিশূল রাখা আছে। আমাদের দলের লোকেরা সেখানে পুজো দিল। আমাদের পুজোর প্রসাদী নকুলদানা দিল। মাথায় সিঁদুর পরিয়ে দিল। জয়টীকা। বেশ কিছুক্ষণ ছবি তোলার পরে যখন দেখলাম অন্য দুটো দল এসে পড়েছে আমরা নামার প্রস্তুতি নিলাম। আর তখনই শুরু হল আসল পরীক্ষা। জীবনে কম রাস্তা নামি নি। সব ট্রেকেই সামিট থেকে নামার রাস্তা দীর্ঘ হয়। কিন্তু এই বালি পাসে এত খাড়াই আর এত মোরেন ঝুরঝুরে রাস্তা, যে আপনাকে পদে পদে বিপদ নিয়ে চলতে হবে। সামান্য ভুল হলেই আপনি গড়িয়ে এতটাই নিচে পড়বেন যে আপনার হাড়গোড় ভাঙ্গতে বাধ্য।

নামার সেই মোরেন ঢাকা খাড়াই রাস্তা।

  অনেকেরই চলতে অসুবিধে হচ্ছিল। আমাদের গাইডরা অনেককেই হাতে ধরে নামতে সাহায্য করছিল। এখান থেকে নামতে গিয়ে বেশ কিছু দুর্ঘটনা ঘটেছে। আমরা তাই খুব সাবধানে হাঁটছিলাম। পাথুরে পথ বহুকষ্টে নেমে আমরা আবার বিক্ষিপ্ত তুষার রাজ্যে পা রাখলাম। নরম তুষারে পা ডুবে যাচ্ছে। তাই সামনের জনের পায়ের ছাপ দেখে পা দিতে হচ্ছে। অন্যদিকে পা দিতে গিয়ে আমার পা একবার ডুবে গেল হাঁটু অবধি। কিছুদূর নেমে আমরা একটা ছোট লেকের কাছে এলাম। এর নাম বালি লেক। যদিও এখন তার জল সম্পূর্ণ জমে বরফ হয়ে আছে।

অবশেষে।

  এরপর আমরা একবার পাথুরে রাজ্য আরেকবার বরফের রাজ্য এভাবে পার হতে হতে আর প্যারাসুটের মত নিচে নামতে নামতে ক্রমে এমন এক জায়গায় এলাম যেখান থেকে বরফের সাম্রাজ্য শেষ হয়ে গেল। অনেক দূরে বালি পাসের দিকে তাকাচ্ছিলাম। বিশ্বাসই হচ্ছিল না যে ওই পথটা নেমে এসেছি। সামনের দিকে তাকালাম। যতদূর দৃষ্টি যায় শুধুই পাথরের উপত্যকা। রুক্ষতা আর শুষ্কতা। সবুজের চিহ্নমাত্র কোথাও নেই। বালি পাস থেকে লোয়ার ধামিনি যাবার এই রাস্তায় খুব ভুল হয়। আর একবার ভুল হলে ফিরে আসা মুশকিল। তাই আগের যাত্রীরা পথের ধারে ধারে কেয়ার্ন্স বানিয়ে রেখেছে। কেয়ার্ন্স হল পাথর সাজিয়ে উঁচু করে রাখা ছোট চূড়ার মত। ওই দেখে সবাই চলার রাস্তা ঠিক করে পাহাড়ে। আগের যাত্রীরা উঁচু পাথরের ওপর কেয়ার্ন্স বানিয়ে রেখেছে, যাতে তুষারপাত হলেও তা ঢেকে গিয়ে বিভ্রম সৃষ্টি না করে। পাহাড়ে আপনি যত যাবেন তত দেখবেন এখানে একদল মানুষ আরেকদলের দিকে এভাবেই সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দেয়।  

  নামছি তো নামছিই। এ পথের যেন কোনো শেষ নেই। অন্য সব ট্রেকেই নামার পথে কিছু কিছু সমতল এলাকা থাকে। বালি পাসে শুধুই খাড়াই প্রায় সব নামাই ৪৫ ডিগ্রি কোণে। কোথাও কোথাও সেটা ৯০ ডিগ্রিও হয়ে গেছে। পায়ের আঙ্গুলে চাপ দিয়ে নামতে নামতে দুটো কাফ মাসল মনে হয় যেন ছিঁড়ে যাবে। তবু চলা ছাড়া কোনো উপায় নেই। খালি যাচ্ছি আর ভাবছি কখন আমাদের ক্যাম্প দেখা যাবে। কিন্তু সেই আশা দুরাশাই হয়ে যায়। এভাবে নামতে নামতে আমরা এসে পৌঁছলাম আপার ধামিনিতে।

  এখানে এসে একটা জলের ধারা দেখতে পেলাম। সবাই মাথা মুখ জলে ধুয়ে বোতলে জল ভরে নিল। তারপর আরো বেশ কিছুটা নেমে আমরা এমন এক জায়গায় এলাম যার নীচে প্রায় পাতালে তাকিয়ে লক্ষ্য করলাম নীচ দিয়ে যমুনা নদী বয়ে যাচ্ছে। কাছেই যমুনোত্রী। সেই যমুনোত্রী হিমবাহ থেকে যমুনা এই পাহাড়ি পথ বেয়ে নীচে বয়ে চলেছে। একে ক্লান্তি তার পরে খিদে, অত নীচে তাকালে মাথা ঘোরাচ্ছে। তাই সেই পাহাড়ের মাথায় বসে আমরা আমাদের প্যাকড লাঞ্চ খেতে শুরু করলাম। বাঁধাকপির তরকারি আর রুটি। রাত থাকতে বানানো। বাঁধাকপিও সেদ্ধ হয় নি আর রুটিগুলোও শক্ত রাবার হয়ে গেছে। পেটে রাক্ষুসে খিদে। তাই খেয়েই জল খেলে কিছুটা যেন শান্তি পেলাম।

কেয়ার্ন্স।

  এর পরে আমাদের জন্য যে পথ অপেক্ষা করছিল সেটাই বালি পাসের সবচেয়ে বিপজ্জনক রাস্তা। একদম ৯০ ডিগ্রি খাড়াই এক রাস্তা যেটা মূলত পাহাড়ি ছাগলদের নামার জন্য। আপনি পাশাপাশি দুটো পা ফেলতে পারবেন না। প্রচুর বাঁক। ওই রাস্তাতেই অনেকগুলো রোপ লাগানো আছে। এক হাতে রোপ ধরে অন্য হাতে ব্যালেন্স করে প্রায় ৫০০ মিটার পথ নামতে হল। সামনের কেউ ব্যালেন্স হারিয়ে রোপে বেশি টান রাখলে পেছনের জন ঝুলে পড়ছে। এখানেই ছয় মাস আগে একজন নেপালি পোর্টার নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে নীচে যমুনায় পড়ে মারা যায়। তার দেহ ওই উচ্চতা থেকে পড়ার ফলে মাংসপিণ্ডে পরিণত হয়েছিল। পরে পুলিশ এসে তার দেহ উদ্ধার করে। যারা এই ট্রেক করাতে নিয়ে আসেন তারা এই পথের কথা তাদের ওয়েব সাইটে কোথাও উল্লেখ করে না। যারা পাহাড়ি রাস্তায় মাথা ঘোরাবার সমস্যায় ভোগেন তারা অবশ্যই এই ট্রেকে আসার আগে চিন্তা করবেন। আর বয়স্কদের না আসাই ভালো।

বিপজ্জনক সেই পাহাড়ি ছাগল নামার রাস্তা।

  কোনো রকমে নীচে সবাই একে একে নেমে এলাম। ওপরে তাকিয়ে দেখলাম কী পথ নেমে এসেছি! আসলে নীচে নামার অন্য পথ আছে। কিন্তু তাতে করে ঘুরে নামতে আরো ঘন্টা দেড়েক বেশি লাগে। তাই বিকাটের লোকেরা শর্টকাট এই রাস্তা বানিয়ে রেখেছে। শুধু এই রাস্তার জন্যই আমি আর দ্বিতীয়বার কোনোভাবেই এই ট্রেকে আসতে চাই না। বয়স বেড়ে গেছে। খুব ঝুঁকি নিয়ে আর কিছু করব না এমনটাই ঠিক করেছি। চলার আনন্দ আর পাহাড় দেখার রোমাঞ্চটুকু যেন থাকে। তাহলেই যথেষ্ট।

  এরপরে পথ অপেক্ষাকৃত সহজ হয়ে এল। তবুও দীর্ঘ পথ। সেই পথ পার হয়ে লোয়ার ধামিনিতে আমাদের ক্যাম্পসাইটে যখন ফিরে এলাম তখন খুঁড়িয়ে খুঁড়িয়ে হাঁটতে হচ্ছে। বুঝলাম এই জ্বালা আরো দিন দশেক চলবে। লোয়ার ধামিনিতে আমাদের ক্যাম্পের চারিদিকে উঁচু উঁচু সিডার গাছ। জায়গা খুবই কম। অল্প একটু সমতল জায়গায় কায়দা করে টেন্ট খাটানো হয়েছে। দূরে দেখা যাচ্ছে জান কি চাট্টি। কাল আমাদের ওখানেই নেমে যেতে হবে।

লোয়ার ধামিনিতে আমাদের ক্যাম্প।

  সকালে ঘুম ভাংতেই আমাদের মধ্যে বিদায়ের ধ্বনি বেজে উঠল। অঙ্কুশ সকালেই বেরিয়ে গেল যমুনোত্রী মন্দিরে পুজো দিতে। ওকে আরো দেড় ঘন্টা হেঁটে মন্দিরে যেতে হবে। আমার পুজোয় ভক্তি নেই। মা যমুনার কাছাকাছি এসেছি এতেই আমার সিদ্ধি। সকালে আমরা জান কি চাট্টির দিকে রওনা হলাম। প্রায় দেড় ঘন্টা নামার পরে দেখতে পেলাম যমুনোত্রী যাবার জন্য তীর্থযাত্রীদের পাগলের মত ভিড়। এক হপ্তা বাদে আমরা আবার মানুষের রাজ্যে প্রবেশ করলাম।

তীর্থযাত্রী।

  মানুষ মানে লোকের মাথা লোকে খাচ্ছে। সে পথে চলাই মুশকিল। চারধাম যাত্রা শুরু হয়েছে মে থেকে। এখন যাকে বলে পিক সিজন। সারা ভারত থেকে লোকেরা এখানে প্রতিদিন আসছে। গঙ্গোত্রী মন্দিরেও গিয়েছিলাম। কিন্তু সেখানে এমন পাগলপারা ভিড় ছিল না। বৃদ্ধ-বৃদ্ধাদের সাথে যুবক শিশু বালিকা যুবতী স্বামী-স্ত্রী কে নেই। আই ফোনে গান শুনতে শুনতে ডোলি করে যাওয়া কর্পোরেট বাবু থেকে হাঁটু বেঁকে যাওয়া ভিখিরি সকলেই পুন্য লাভের জন্য চলেছে! মেয়েরা সবাই এই সকালে ঠোঁটে লিপস্টিক গালে রুজ লাগিয়ে বেশ সেজেগুজে চলেছে। সেখানে আমাদের অবস্থা তাড়া খাওয়া কয়েদিদের মতো। তাই প্রবল ইচ্ছে করলেও তাদের দিকে তাকাতে লজ্জা করছিল। পনিদের গায়ের ও বিষ্ঠার গন্ধে পুরো রাস্তাটা মঁ-মঁ করছে। কেউ শশা, কেউ পরোটা, কোল্ড ড্রিঙ্কস কেউ বা আবার শিলাজিৎ বিক্রি করছে। মহাবীর বলল এগুলো সবই নকল। আসল শিলাজিৎকে নাকি বলে ‘পাহাড় কে পসিনা’। খাড়া ক্লিফের গায়ে গায়ে তাকে পাওয়া যায়। সেগুলো সংগ্রহ করা সহজ নয়।

শিলাজিৎ বিক্রেতা।

  অন্তহীন নীরবতা থেকে সমগ্র ভারতবর্ষকে বিস্মিত হয়ে দেখতে দেখতে আমরা জান কি চাট্টিতে এসে পৌঁছে গেলাম। আমাদের বালি পাস ট্রেকও শেষ হল। আমাদের জন্য গাড়ি দাঁড়িয়েই ছিল। তাতে উঠে এবার আজ বিকেলে দেরাদুন। রাতের বাস ধরে ভোরে দিল্লি। সকালের ফ্লাইট ধরে কাল দুপুরে বাড়ি। পাশেই বয়ে চলেছে যমুনা। কিন্তু প্রতিটি ধর্মস্থানকেই আমরা কী ভীষণ আবর্জনাময় করে তুলি। যমুনার জলে ভাসছে ছেঁড়া কাপড়। প্রচুর প্লাস্টিক। পারে অনেক টয়লেট টেন্ট। ওপরের পাহাড় যেখানে সহজে মানুষের পা পরে না তা কেমন স্নিগ্ধতায় পবিত্র হয়ে আছে। এই যমুনোত্রী ধামে এত লোকের ভিড়ে এই কদর্যতায় সেই পবিত্রতা কোথায়? মানুষ যমুনাকে মা বলেই সম্বোধন করেছে, তাকে মর্যাদা দেয় নি। তার মনে নিজের কার্যসিদ্ধির ভাবনা আছে। নদীকে পবিত্র রাখার, মাকে নিজের ঘরে ভালোভাবে রাখার কোনো বাসনা নেই।

জান কি চাট্টি।

  উনি নিজেকে আলাদা সরিয়ে রেখেছেন। পাতায় পাতায় তার ভাষা। বরফের সাদা তার নির্জনতা। এখানে কোনো ভাষা সৃষ্টি হয় না। ভেতর থেকে একটা গম্ভীর ওম্‌ ওঠে। উনি নিজেও খোঁজেন সেই ভাষাকে। পাপ বেদনা লোভ হতাশা সবাইকে এখানে তাড়িয়ে এনেছে। বিপথগামিতা আত্মনিবেদন, পুজোর নৈবেদ্য তার কাছে কি পৌঁছায়? তবু এই পাগলপ্রায় পিঁপড়ের শ্রেণী নিজেদের আরো ঝাপসা করে তোলে। কে জানে অভিমানী মা কোথায়? তবে শূন্য মন্দিরে তিনি নেই।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *