স্টেথোস্কোপঃ৫৪

এই কারণে আমাকে স্টেথোস্কোপ লিখতে হবে এর আগে কখনও ভাবি নি। কালকে রাতে শুয়ে শুয়েই ভাবছিলাম চারিদিকে শুধু করোনা নিয়েই কথাবার্তা আলোচনা হচ্ছে। টিভি খুললে, কাগজ খুললেই করোনা। লোকের চোখে-মুখে, কথায়-বার্তায়, আলাপ-আলোচনায় শুধুই ভাইরাস নিয়ে উদ্বেগ। তারপর দীর্ঘদিন এই গৃহবন্দী থাকার জন্য মানুষের আংশিক মানসিক ভারসাম্যও সাধারণভাবে চলে যায়। এমন আর বেশিদিন চলতে থাকলে লোকজন হয়ত নানান অদ্ভূত আলোচনা করতে শুরু করবে। আরও অলৌকিক কল্পনা করতে শুরু করবে। আরও কি কি আমাদের শুনতে ও বুঝতে হবে সেটা সময়ই বলবে কিন্তু এই মুহূর্তে আমাকে কেন্দ্র করে ঘটে যাওয়া সাম্প্রতিক একটা খবরে ব্যাপারে আমি আপনাদের দৃষ্টি আকর্ষণ করতে চাইছি।
আপনারা হয়ত অনেকেই শুনেছেন বা জানেন আমি ব্যারাকপুরে যে সাধু মুখার্জি রোডে থাকি সেখানে গত দু-দিন আগে একজন অ্যাপোলো হসপিটালের টেকনিশিয়ান যে স্ত্রী ও সন্তান নিয়ে থাকত তার করোনা সংক্রমণ ধরা পড়েছে। আমি যেহেতু ডাক্তার তাই তার নাম বা এর থেকে বেশি কিছু আমার পক্ষে লেখা উচিত নয়। কারণ যে কোনো ছোঁয়াচে অসুখ একদিকে যেমন ‘নোটিফায়েবল’ মানে প্রশাসনকে জানানো প্রয়োজন অন্যদিকে রুগির গোপনীয়তা ও নিরাপত্তার কথাও সবসময় ভেবে দেখা উচিত। যদিও গতকাল থেকেই আমার এবং হয়ত আপনাদের হোয়াতেও আক্রান্ত রুগির নাম, বয়স এবং তার রিপোর্টের কপি ভাইরাল হয়ে ছড়িয়ে পড়েছে। এটা কে এবং কিভাবে ছড়িয়েছে আমি জানি না কিন্তু এটা অত্যন্ত অসঙ্গত কাজ। যাই হোক প্রশাসন ব্যবস্থা হিসেবে তার বাড়ির গলিটিকে বাঁশ দিয়ে বন্ধ করে দিয়েছে এবং স্যানিটাইজ করেছে। আমি যদিও এসব কথা বলছি ঠিকই কিন্তু আমি নিজের চোখে তা দেখি নি কারণ এই মুহূর্তে রোস্টার ডিউটিতে আমি মালদা মেডিকেল কলেজে আছি। আমি আমার বাড়ির লোকেদের এবং অন্যান্যদের শেয়ার করা ছবি থেকে সবটা জানতে পারছি।
এত কথা বলার আমার প্রয়োজন ছিল না। কিন্তু বলতে হচ্ছে পরবর্তী অংশের জন্য। আজ সকালে ঘুম থেকে ওঠার সাথে সাথেই আমার মা এবং বউ ফোন করে জানায় যে তারা শুনেছে ব্যারাকপুরে নাকি রটে গেছে যে কোভিড আক্রান্ত পেশেন্টটি বর্তমানে হাসপাতালে ভর্তি আছে সে আমারই পেশেন্ট এবং অসুস্থ হবার সময় আমাকেই দেখিয়েছিল। তাই প্রশাসনিক কর্তারা রুগির সাথে আমাকেও কোয়ারান্টাইন করেছে এবং বাড়ি থেকে তুলে নিয়ে গেছে। ঘটনাকে আমি প্রথমে অতটা বিশ্বাস করি নি বা গা করি নি। কিন্তু খুব সময়ের মধ্যেই এই গুজবটা আমাদের এলাকায় দাবানলের মত ছড়িয়ে পড়ে। ‘দাবানলের মত’ কথাটায় নাটকীয়তা থাকতে পারে সেটা স্বীকার করেই বলছি এর মধ্যেই গত এক ঘণ্টায় আমাকে খুব কম করে দু’শ জন লোক ফোন করেছেন। তাদের মধ্যে আমার আত্মীয়রা যেমন আছেন তেমনই আমার বন্ধু, পেশেন্ট এবং এমন অনেকেই আছেন যাদের আমি চিনি না।
সেই সময় আমি বিষয়টার গুরুত্ব বুঝতে পারলাম এবং আমার মনে হল এটা নিয়ে কিছু লেখা উচিত। যেহেতু অনেকেই আমাকে ফেসবুকে ফলো করেন তাদের মাধ্যমে আমার বক্তব্যটা সকলের না হোক অনেকের মধ্যেই ছড়িয়ে পড়বে। তারপরও অনেকের মধ্যেই অবিশ্বাস, সন্দেহ ও আতঙ্ককে আমি দূর করতে পারব না। কিন্তু আমি যেটুকু করতে পারি সেটুকুই এখানে করার চেষ্টা করছি।
প্রথম কথা হল পাড়াটা যেহেতু আমার তাই আমার পাড়ার কেউ আমাকে দেখাতেই পারেন। এই মাসে আমি প্রথমদিকে দু-সপ্তাহ চেম্বার করেছিলাম মালদায় আসার আগে। তাই সেই সময় আমি তাকে দেখে থাকতেই পারি। কিন্তু আমার স্মৃতি যেহেতু খুব শক্তিশালী নয় তাই তার নাম শুনে আমি বলতে পারছি না যে আমি তাকে দেখেছি কিনা। মুখ দেখলে হয়ত চিনতাম। তবু বলি নাম শুনে আমার মনে হচ্ছে না ওই নামে আমার পাড়ার কাউকে আমি ওই সময়ের মধ্যে দেখেছি। আমার পাড়ার লোকেরা যদি মনে করেন যে আমার পাড়ার লোক মানেই সে আমাকে দেখিয়েছে তা ঠিক নয় কারণ আমার পাড়ার সবাই আমাকে দেখানও না এবং চারপাশে অন্যান্য ডাক্তারদেরও কোনো অভাব নেই।
দ্বিতীয় কথা আমাকে ব্যক্তিগত চেম্বারেই হোক বা হাসপাতালেই হোক পেশেন্ট যখন দেখতেই হবে তখন বেছে বেছে পেশেন্ট দেখা আমার পক্ষে সম্ভব নয়। ডাক্তার হিসেবে আমি কখনই বলতে পারি না যে সর্দি-কাশির রুগি আমি দেখব না। আর সর্দি-কাশি-জ্বর ছাড়াও কত যে ‘অ্যাসিম্পটোম্যাটিক কেরিয়ার’ করোনা নিয়ে ঘুরে বেড়াচ্ছে তার ঠিক নেই। আমাদের মত দেশ বা রাজ্যে যেখানে আর্থিক দৈন্যে এবং নিজেদের দীনতা গোপন করার জন্য খুব কম সংখ্যায় পরীক্ষা করা হচ্ছে তাই সত্যিকারের করোনা আক্রান্ত কে তা বোঝা খুবই কঠিন। তাই তাকে আমি দেখে থাকলেও অন্যায় কিছু করি নি বলেই আমার বিশ্বাস।
আমি গত সপ্তাহে যখন একটা ফেসবুকে পোস্ট করি যে আগামি লকডাউনের সময় আমি পেশেন্ট দেখব না আমাকে অনেকে ফোনে অপমান করেছিলেন। পাড়ার অনেকে ট্যাঁড়া কথায় আমাকে বুঝিয়েছিল যে কাজটা আমি মোটেই ভাল করছি না। ডাক্তার না দেখলে রুগিরা কোথায় যাবে? আমি অনেককে বলি যেহেতু আমাকে আগামি সপ্তাহ মালদায় থাকতে হবে তাই মালদা থেকে ফিরে এসে আমি এই ব্যাপারে সিদ্ধান্ত নেব। অনেকে আবার এ কথাও বলে আমি নাকি বাড়িতে লুকিয়ে থেকে পেশেন্ট দেখছি না। তাহলে ব্যাপারটা কি দাঁড়াল? যখন আমি দেখতে চাইছি না তখন তারা আমাকে জোর করছেন আর আজ যখন আমি সত্যিই বাড়িতে নেই তারা গুজব ছড়াচ্ছেন আমি করোনা আক্রান্ত এবং আমাকে কোয়ারান্টাইনে পাঠানো হয়েছে। বাড়িতে আমার মা মেয়ে বউ থাকে। সত্যি মিথ্যের এই আবাহাওয়ায় তারাও উৎকন্ঠিত।
ব্যাপারটা এটুকু হলেও ঠিক ছিল। আমার একজন পেশেন্ট আমাকে ফোন করে বলল, আমার পাড়ার লোকেরা নাকি এমনও বলছে যে তারা আমাকে হাসপাতালে নিজেরাই ভর্তি করে দিয়ে এসেছে। সেই মেয়েটি চিন্তিত হয়ে আমাকে ফোন করছে যে আমি যদি সত্যিই কোভিডে আক্রান্ত হয়ে থাকি তাহলে সে যে তার বৃদ্ধ মাকে গত সপ্তাহে আমার কাছে দেখিয়ে গেছে তার মা’র আক্রান্ত হবার সম্ভাবনা কতটা। সে লজ্জিত হয়ে এও জানিয়েছে যে সেও বিশ্বাস করে এটা গুজব তাই অনোন্যপায় হয়েই আমাকে ফোন করছে। তাহলে বুঝে দেখুন আমি কোন অবস্থার মধ্যে আছি।
আমার প্রথম সমস্যা আমি বাড়ি থেকে ৩০০ কিমি দূরে। তাই সবাইকে আমার উপস্থিতি প্রমাণ করা এখনই সম্ভব হচ্ছে না। গত দুবার নিজের গাড়ি চালিয়ে এসেছি এতটা রাস্তা। এবার বাড়ির লোকের বিরোধিতায় স্বাস্থ্যভবনের বাসে এসেছি। সরকারি বাস দিয়ে যাবে কিন্তু ফিরিয়ে নিয়ে যাবে না। আবার প্রশাসকরা বলছে সাতদিন ডিউটি করলে সাতদিন ছুটি। তাই নিজেকেই ব্যবস্থা করে ফিরতে হবে। এর মধ্যে গুজব আরও ঘনীভূত হবে। আর আমার চিন্তা হচ্ছে এটা হওয়াও অসম্ভব না যে পাড়ার লোকেরা আমাকে হয়ত বাড়িই ঢুকতে দিল না। সেটা আরও মারাত্মক ব্যাপার। কারণ আমি বুধবারই হয়ত ফিরব। আমার গাড়ি বারাসাতে রাখা আছে। সেখান থেকে নিয়ে ফিরব। এলাকাবাসীর সন্দেহ ঘনীভূত হলে তারা আমার ও বাড়ির লোকের ওপর হুজ্জতি করতে পারে।
আসলে আমি যে আমার সমস্যার কথা বললাম এই সমস্যা শুধু আমার নয় আজ সব ডাক্তাররাই এই সমস্যার মধ্যে দিয়ে যাচ্ছেন। আমাদের পেশেন্ট দেখলেও সমস্যা না দেখলেও সমস্যা। দেখলে লোকে আমাদের কোভিড আক্রান্ত বলে সন্দেহ করছে, না দেখলে স্বার্থপর বলে গালাগালি করছে। এর কোনোটাই আমাদের পক্ষে খুব স্বাস্থ্যকর নয়। শেষে যে কথাটা বলার তা হল আমরা ডাক্তাররা কেউ সমাজের বাইরে নই। আপনারা যেমন প্রয়োজনে আমার কাছে আসেন আমিও আপনাদের থেকে উপকৃত হই। এই অসময়ে যখন সারা পৃথিবী একটা অসম লড়াইয়ের মধ্যে দিয়ে যাচ্ছে তখন আমাদের মত ডাক্তারদেরই আপনাদের সবচেয়ে বেশি করে দরকার। তাই আপনারা যদি এরকম ভিত্তিহীন গুজব ছড়িয়ে আমাকে একঘরে করার চেষ্টা করেন তাতে কিন্তু আমার আপনাদের ওপর বিশ্বাস ও আস্থা কমে যেতে বাধ্য। হতে পারে আপনারা এখন আমাদের মতই মানসিকভাবে আংশিক বিপন্ন তবু কাউকে নিয়ে বেমক্কা গুজব ছড়ানোর আগে পারিপার্শ্বিকতা বিচার করার দায়িত্ব থেকে আপনারা নাগরিকেরা কিন্তু নিজেদের মুক্ত বলে দাবি করতে পারেন না। এতে আমি বা আপনারা কেউই কিন্তু ভবিষ্যতে উপকৃত হব না।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *