স্টেথোস্কোপঃ৫৯

মার্চ থেকে শুরু হয়ে করোনার আক্রমণ প্রায় ছ’মাস হতে চলল। এখনও সে কিছুই কমার লক্ষণ দেখাচ্ছে না। বরং উত্তরোত্তর সংক্রমণ বেড়েই চলেছে। তার সাথে পাল্লা দিয়ে বেড়ে চলেছে মৃত্যুর হার। তবে আজকে আমি সেইসব হতাশার পুরনো পাঁচালি পাঠ করতে আসি নি। আমি আমার চারপাশে যেসব পেশেন্টদের দেখেছি তাদের নিয়ে আমার মত একজন সাধারণ চিকিৎসকের অভিমত জানানোর জন্যই এসেছি। আমার নিজস্ব অভিজ্ঞতা কিন্তু খুব খারাপ কিছু নয়। অন্তত শুরুর দিকে আমার যেমন ভয়াবহ বলে একে মনে হয়েছিল আমার ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতা ঠিক ততটা খারাপ নয়।

  আমি যেহেতু করোনার শুরু থেকে আজ প্রায় একটানা ছ’মাস আমার চেম্বারে রুগি দেখে চলেছি তাই শুরুর দিকের ভয়াবহতা, সন্দেহ, অবিশ্বাস ও হতাশা থেকে শুরু করে আজ অবধি সবার মানসিকতার বিবর্তন আমার চোখে পড়ছে। আমি লক্ষ্য করেছি যে মানুষ তাদের প্রাথমিক দিশেহারা ভাবটা অনেকটা কাটিয়ে উঠেছে। মানুষ তার মনের জোর অনেক বাড়িয়ে এই মহামারীর মোকাবিলা করছে। মানসিক এই শক্তিটা তাদেরকে কিন্তু করোনার মোকাবিলায় অনেকটা এগিয়ে দিয়েছে। যিনি আক্রান্ত হয়েছেন তার সাথে তার বাড়ির ও পাড়ার লোকেরা প্যানিক কাটিয়ে উঠে সেই আক্রান্ত ব্যক্তির সুস্থ হয়ে ওঠায় সাহায্য করেছেন। তার পরিজন ও বন্ধু ছাড়াও অটোওলা, টোটোওলা, ওষুধের দোকানের কর্মী, অ্যাম্বুলেন্সের চালক, সব্জি বিক্রেতা, দোকানদার আরও অনেক মানুষের সহযোগিতার ফলেই এটা সম্ভব হয়েছে। নিন্মবিত্ত মানুষেরা তাদের জমানো পুঁজির তলানিতে পৌঁছোলেও মানবিকতা হারাননি। সবাই একে অন্যের দিকে সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দিয়েছে। প্রথমদিকে যখন সবাই আতঙ্কগ্রস্ত সেসময় এটা হয় নি কিন্তু ধীরে ধীরে মানুষ তার স্বার্থপরতার কাছে আত্মসমর্পণ না করে সাহস নিয়ে এগিয়ে এসেছে। আমার মত আপনারাও সকলে নিশ্চই এটা লক্ষ্য করেছেন। এটা কিন্তু আমাদের সমাজের একটা অত্যন্ত সুলক্ষণ। আমরা যারা মানুষ ও সমাজ নিয়ে দৈনিক খবরের কাগজের মত কেবল খারাপ দিককেই তুলে ধরে তৃপ্তি পাই তারা হয়ত বুঝতে পেরেছি নিজেদের অস্তিত্ব রক্ষার প্রয়োজনে অনেক কঠিন অবস্থাতেও আমরা আবার সংঘবদ্ধ হতে পারি। যে কথাগুলো বলছি এর মধ্যে কোনো নাটকীয়তা নেই, সিনেম্যাটিক ক্লাইম্যাক্স নেই। এই কথাগুলো আজকে এসে আমি সত্যিই অনুভব করছি।

  নিজেকে প্রশ্ন করেছি এটা সম্ভব হল কিভাবে? একটা কারণ অস্বীকার করার জায়গা নেই যে মিডিয়াগুলো দীর্ঘদিন ধরে একটানা করোনার ভয়াবহতা প্রচার করে কিছুটা ক্লান্ত হয়ে পড়েছে এবং মানুষও সেই খবর দীর্ঘদিন ধরে গিলে গিলে অজীর্নের কবলে পড়েছে। তাই খবরের থেকে চোখ সরিয়ে সে তার চারপাশের পৃথিবীর দিকে তাকিয়েছে। তারা দেখেছে যে তার চারপাশের করোনার সংক্রমণ বেড়ে গেলেও যারা আক্রান্ত তাদের মধ্যে মৃত্যুর থেকে সুস্থ হওয়ার হারই বহুগুণ বেশি। সত্যি বলতে গেলে আমাদের পশ্চিমবঙ্গের মত বিপুল জনসাধারণের মধ্যে সেই মৃত্যুর হার প্রায় চোখেই পড়ে না। যারা মারা যাচ্ছেন তাদের মধ্যে অধিকাংশই বৃদ্ধ বা বয়স্ক এবং অন্য নানান রোগের শিকার। তারা করোনা না হলেও নিউমোনিয়া বা হার্ট অ্যাটাকে যে কোনো সময়ই মারা যেতে পারতেন। তাই ‘মৃত্যুর মিছিল’ বা এরকম কিছু উপমা যা প্রথমে ভাবা হয়েছিল তেমনটি হয় নি। আরেকটা বড় ব্যাপার আমাদের দেশের লোকেরা যেহেতু বেশিরভাগই গরিব তারা অপুষ্টিতে ভুগলেও কষ্টসহিষ্ণু। তাই জীবনের প্রাত্যহিক লড়াইয়ের কাছে তাদের করোনাকে এমন কিছু আলাদা বলে মনে হয় নি।

  আমার চেম্বারে আগে যত রুগিদের করোনা ধরা পড়ছিল তার থেকে এখন অনেক বেশি সংখ্যায় লোকের করোনা ধরা পড়ছে। আমি এখন দুবেলা আর রুগি দেখছি না। একবেলাই দেখছি। তাতে দিনে পঁচিশ জন রুগি দেখলে তাদের মধ্যে জনা পাঁচ কি ছয়জনের করোনার লক্ষণ দেখতে পাচ্ছি। তাদের মধ্যে খুব বেশি হলে গড়ে দৈনিক তিনজন রুগি টেস্ট করাচ্ছেন বা করাতে পারছেন। তাদের মধ্যে প্রায় দুজনের করোনা ধরা পড়ছে। আমার মনে হয় যদি পাঁচজন টেস্ট করাত তবে চারজনের করোনা ধরা পড়তই। কিংবা যাদের করোনার লক্ষণ সেরকম নেই শুধু দূর্বলতা নিয়ে আমাকে দেখাতে আসছেন তাদেরও টেস্ট করালে সংখ্যাটা খুব কম হত না।

  কিন্তু সবাইকে টেস্ট করাতে পারা যাচ্ছে না। এটা খুব সত্যি কথা। সরকারিভাবে যে টেস্ট হচ্ছে তাতে সবাইকে করানো যাচ্ছে না। প্রাইভেটে আমাদের ব্যারাকপুরে মাত্র একটি ল্যাব টেস্ট করছে। আমার শোনা তারা ২৭০০-৩২০০ টাকার মত নিচ্ছে। সবাই তাই সেই পরীক্ষা করাতে পারছে না। তবুও আমি বলব সরকারি বা বেসরকারিভাবে আগে যতজন টেস্ট করাচ্ছিল গত দেড়মাসে সেই টেস্ট করার সংখ্যা অনেক বেড়ে গেছে।

  আজ পর্যন্ত আমার যতজন রুগির করোনা ধরা পড়েছে বলে আমি জানি তাদের কারোর মৃত্যুর খবর আমি পাই নি। একজন কিডনি ফেইলিওরের রুগি ছিলেন। তাকে নিয়ে আমার খুব দুশ্চিন্তা ছিল কিন্তু তিনি পাঁচদিনেই হাসপাতাল থেকে ছাড়া পেয়ে দিব্বি বাড়ি চলে এসেছেন এবং দিব্য আছেন। আমার অধিকাংশ রুগিদের করোনার লক্ষণ মারাত্মক না হওয়ায় তারা বাড়িতেই ‘হোম কোয়ারান্টাইনে’ আছেন। আমার সাথে হোয়াতে, ফোনে যোগাযোগ রাখেন এবং ভালই আছেন। কয়েকজন শ্বাসকষ্টের রুগি যাদের অক্সিজেন স্যাচুরেশন খুব কমে যাওয়ায় হাসপাতালে পাঠিয়েছিলাম তারা ভেন্টিলেটর ছাড়াই সুস্থ হয়ে বাড়ি চলে এসেছেন। অনেকেই করোনার পর আবার টেস্ট করিয়ে নেগেটিভ রিপোর্ট আসায় কাজেও যোগ দিয়েছেন। আমার আমার এলাকায় চারপাশেও আমি সেভাবে প্রচুর সংখ্যায় মৃত্যুর খবর পাই নি। এর থেকেই আমার মনে হয়েছে আমরা হয়ত এই ভয়ানক ভাইরাসের মোকাবিলায় অনেকটাই সফল হতে পেরেছি। সত্যি বলতে কি শুরুর দিকে এমনটা যে হতে পারে আপনাদের সবার মত আমিও তা ভাবি নি। কিন্তু এটা যে হচ্ছে বা হয়েছে এটা কিন্তু সত্যি।

  তা বলে কি করোনায় কেউ মারা যাচ্ছে না, বা অল্প বয়েসিরা কেউ মারা যাচ্ছে না? মোটেই তা নয়। এখনও পর্যন্ত এ নিয়ে গা ছাড়া মনোভাব তৈরি হবার কোনো জায়গাই নেই। তবে এখনও পর্যন্ত আমার যা মনে হয় প্রাথমিক ধাক্কাটা কিন্তু আমাদের মত গরিব দেশের, গরিব রাজ্যের মানুষ তাদের অতি সীমিত সামর্থ নিয়ে যথেষ্ট কৃতিত্বের সাথে সামলে দিয়েছেন। আর সবচেয়ে যেটা বড় কথা আমাদের ডাক্তারদের সাথে সাথে সাধারণ মানুষেরাও এই অজানা আতঙ্ককে কিভাবে মোকাবিলা করবেন তার একটা প্রাথমিক রূপরেখা যে যার মত করে তৈরি করে নিয়েছেন। এর ফলেই অনেকটা সাফল্য এসেছে।

  বৌদ্ধ সাহিত্যে খুব সুন্দর একটা গল্প আছে। বৌদ্ধ সাহিত্যে প্রথম দিকে তো দেবদেবী কিছু ছিল না। বুদ্ধদেব দেবদেবীতে বিশ্বাস করতেন না। পরবর্তীকালে মহাযান বৌদ্ধধর্ম প্রচলিত হওয়ায় ও তান্ত্রিকতার প্রচার হওয়ায় দেবদেবী আসে। তবে প্রথম থেকেই শয়তান কিন্তু বৌদ্ধসাহিত্যে আছে। তার নাম ‘মার’। বুদ্ধদেব যখন তপস্যা করছিলেন বুদ্ধত্ব লাভের জন্য তখন এই মার তাকে নানাভাবে বিব্রত করেছিল। এই মারের হাত থেকে কিভাবে মুক্তি পাওয়া যাবে তা বুদ্ধ তার শিষ্যদের বুঝিয়েছেন এক গল্পের মধ্যে দিয়ে। দীঘিতে এক কচ্ছপ থাকে। এক শিয়ালের খুব লোভ তাকে ধরে খায়। একদিন তাকে কাছে পেয়েও গেল। যেই খেতে যাবে অমনি কচ্ছপটি বাঁচার জন্য খোলসের ভেতরে ঢুকে পড়ল। শিয়ালটা সারাদিন ধরে তার আশে পাশে ঘুরে বেড়াল তাকে নানাভাবে উত্যক্ত করল যাতে হাল ছেড়ে দিয়ে সে খোলসের বাইরে তার মুখটা বের করে। কিন্তু কচ্ছপ কিছুতেই খোলসের বাইরে এল না। শিয়াল হতাশ হয়ে সারাদিন পণ্ডশ্রমের পর খিদের তাড়নায় কচ্ছপটিকে রেখেই দূরে খাবারের সন্ধানে চলে গেল। শাক্যমুনি বলেছেন জীবনে মারের হাত থেকে বাঁচতে হলে আমাদের প্রত্যেককেই এভাবে নিজের খোলসের ভেতরে ঢুকে যেতে হয়। যতক্ষণ পর্যন্ত না পরিস্থিতি অনুকূল হয় ততক্ষণ বের হওয়া বারণ। আমরা সকলে নিজেদের অবচেতনাতেই সেই খোলসের ভেতরে ঢুকে গেছি। এখনও বাইরে বের হবার সময় আসে নি। মার নামে শয়তান এখনও অপেক্ষা করে আছে। অনেকটা যুদ্ধ আমরা জিতে গেছি। বাকিটাও ঠিক জিতে যাব।

11 thoughts on “স্টেথোস্কোপঃ৫৯

  • August 2, 2020 at 1:28 am
    Permalink

    I am always your fan. Keep writing like this.

    Reply
    • August 2, 2020 at 7:58 am
      Permalink

      আপনি আমার একবগগা পাঠক। ধন্যবাদ।

      Reply
  • August 2, 2020 at 1:59 am
    Permalink

    Vison i prasangik r bastab satyi.valo laglo

    Reply
    • August 2, 2020 at 7:58 am
      Permalink

      ধন্যবাদ ইশিকা। সঙ্গে থাকিস।

      Reply
  • August 2, 2020 at 7:31 am
    Permalink

    Sir once again a truely experience based outcome from your side..yes the mar is till there..so we have to be cautious at the same time let us live a positive life also…take care of health sir…

    Reply
    • August 2, 2020 at 7:57 am
      Permalink

      ধন্যবাদ নেবেন দাদা। ফলো করবেন।

      Reply
  • August 2, 2020 at 8:50 am
    Permalink

    অপূর্ব লাগল আপনার লেখাটা পড়ে। এটা সত্য, নিজেকে বাঁচাতে সবাই একটা উপায় বেছে নিয়েছে।

    Reply
    • August 4, 2020 at 2:47 pm
      Permalink

      ধন্যবাদ। সঙ্গে থাকবেন।

      Reply
  • August 2, 2020 at 6:35 pm
    Permalink

    খুব সুন্দর হয়েছে ব্লগটা। এটা খুব ভালো করেছো। লোগোটাও বেশ লাগল। বিভাগ করে আগের লেখাগুলো ও আপলোড করে দাও এখানে।

    Reply
    • August 4, 2020 at 2:46 pm
      Permalink

      তুই তো এসব অনেক জানিস। হেল্প চাইব দরকারে।

      Reply

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *