স্টেথোস্কোপঃ ৫৭

আনলক ১ শুরু হবার পর থেকেই চেম্বারে পেশেন্টদের সংখ্যা বেড়ে গেছে। অনেক লোক যারা এতদিন ভয়ে আমার চেম্বারে আসতে সাহস করছিলেন না তারা একে একে আসতে শুরু করেছেন। আমার যেসব রুগিরা ক্রনিক অসুখে ভুগছেন যেমন হাই ব্লাড প্রেসার বা ডায়াবিটিস তারা অধিকাংশের বয়সই পঞ্চাশের ওপরে। তাই তারা স্বাভাবিক কারণেই এতদিন খুব প্রয়োজন ছাড়া বাড়ির বাইরে বিশেষত ডাক্তারের চেম্বারে আসেন নি। কিন্তু লকডাউন আংশিক উঠে যাওয়ায় তাদের অনেকেই আবার আসতে শুরু করেছেন।
এই দীর্ঘ দু-মাস সকলেই খুব কঠিন সময়ের মধ্যে দিয়ে গেছেন। এখনও যাচ্ছেন। তাই এই লকডাউন আমার রুগিদের শরীরে ও মনের ওপর যথেষ্ট খারাপ প্রভাব ফেলেছে। অনেকেই আছেন যারা এই দু-মাস প্রায় কিছুই রোজগার করতে পারেন নি। জমানো টাকায় আর কতদিন চলে? গচ্ছিত টাকাও তাদের তো বেশি নেই। তাই বেঁচে থাকার জন্য ওষুধ বা খাবারের মধ্যে তারা খাবারদাবার বা ছেলেমেয়ের পড়াশোনার খরচকেই প্রাধান্য দিয়েছেন। অর্থাভাবে ওষুধ খাওয়া হয় নি অনেকদিন। অনেকেই তাই প্রেসার বা সুগার অনেকটাই বাড়িয়ে ফেলেছেন। রোজগারের অভাব ও অনিশ্চয়তা মানুষকে মানসিকভাবেও খুব বিপন্ন করে তুলেছে। সেই দুশ্চিন্তার প্রভাবও রোগের ওপর এসে পড়ে।
এক মাস্টারমশাই যিনি কিনা প্রাইভেট পড়িয়েই সংসার চালান গত দু-মাস তার ছাত্রছাত্রীদের থেকে কিছুই মাইনা পান নি। তার ছেলেকে ইংলিশ মিডিয়ামে পড়ান। সেই খরচ ছাড়াও সংসারের খরচ এবং তার সুগার আর প্রেসারের ওষুধের বিরাট ব্যয় তো আছেই। মাস্টারমশাই এই দুর্ভাবনায় ওষুধ ঠিকঠাক খেলেও সুগার অনেক বাড়িয়ে ফেলেছেন। তার স্ত্রী কাঁদোকাঁদো গলায় বলছেন আগামি মাসগুলোতে কি হবে তাও তারা জানেন না। নিম্ন মধ্যবিত্তেরই যখন এই অবস্থা তখন দরিদ্রদের কথা তো ছেড়েই দিলাম। প্রতিদিন বাড়িতে বেশ কয়েকজন এসে ভিক্ষে চান। পোশাক-আশাক দেখে তাদের ভিখিরি বলে মনে হয় না। সবাই খাবার জন্য ভিক্ষে করতে আসেন। গত দু-মাস আগেও এদের আমি চিনতাম না। মালদায় কলেজে সকালে ক্যান্টিনে খেতে গেলে প্রায় প্রতিদিন নতুন নতুন কিছু রিক্সাওয়ালা সাহায্য চান। কাজ নেই বাবু, রোজগার নেই। কিছু সাহায্য করুন। গত দু-মাস আগেও এরা সাহায্য চাইতেন না। মাস্টারমশাইয়ের মত শিক্ষিত মানুষ যারা ওই কাজ করতে পারবেন না বা ওই সাহায্যে তারা সংসার চালাতে পারবেন না, তাদের অবস্থা সত্যিই খারাপ।
একে শারীরিক ও মানসিক চাপ তার ওপর অনিয়মিত ওষুধ খাওয়া, সবার ওপরে নিজেদের ডাক্তারবাবুদের সাথে ঠিকভাবে যোগাযোগ না করতে পারা- এসবের জন্য সুগার, প্রেসার বা হার্টের অসুখের রুগিদের এই সময় হঠাৎ করে ইমার্জেন্সি সিচুএশন তৈরি হচ্ছে। এটা বিগত কয়েক দিন ধরেই লক্ষ্য করছি। এই অবস্থায় পড়লে মানুষেরা যে কি ভয়ঙ্কর সমস্যায় পড়ছেন তা বোঝাতে আমি আমার এক পেশেন্টের অত্যন্ত দুঃখজনক ঘটনা আপনাদের সাথে শেয়ার করছি।
আমার এক বন্ধু মেডিক্যাল রিপ্রেসেন্টেটিভ। সে গত কয়েকদিন আগে হঠাৎ একদিন রাতে আমাকে ফোন করে বলল তার এক চেনা লোক আমাকে দেখাতে চায়। কখন আসবে। আমি পরদিন সকাল দশটায় তাকে আমার চেম্বারে আসতে বলি। চেম্বার খোলার সময় দেখি তারা আগে থেকেই সেখানে হাজির হয়েছে। ভদ্রলোকের বয়স পঞ্চাশের কিছু বেশি। টোটোতে বসে আছেন। তার ছেলে আরেকজন লোক তাকে ধরে ধরে আমার চেম্বারে ঢোকাল। আমার সামনে বসে উনি প্রচন্ড হাঁপাচ্ছেন। উনি আমার কাছে সেদিনই প্রথম দেখাতে এসেছিলেন। জানলাম তার প্রেসার আছে। ওষুধ খান। তিনদিন আগে পেটখারাপ হওয়ায় ডাক্তার দেখান। ওষুধে না কমায় ফোনে ডাক্তারবাবু পরামর্শ দেন হাসপাতালে ভর্তি হতে। সেসময় তার জ্বরও ছিল। কিন্তু এই কোভিডের পরিস্থিতিতে বাড়ির লোক খুব স্বাভাবিক কারণেই তাকে হাসপাতালে নিয়ে যেতে ভয় পান। ডাক্তারবাবুকে জানালে তিনি বাড়িতে স্যালাইন চালাতে বলেন। এদিকে তার প্রেসার অন্য কাউকে দিয়ে চেক করিয়ে তারা দেখেন তা কমে গেছে। ডাক্তারবাবু প্রেসারের ওষুধ বন্ধ রাখার কথা বলেন। পাড়ার লোককে দিয়ে তারা বাড়িতে স্যালাইন চালান। ইঞ্জেকশনও নেন। তার জ্বর ও পায়খানা দু-দিন পরে কমে যায় কিন্তু গতকাল থেকে শ্বাসকষ্ট শুরু হয়। তাই আজকে তারা আমার কাছে তাকে নিয়ে এসেছেন।
পেশেন্টের শ্বাসকষ্ট দেখে আমি পরীক্ষা করে দেখলাম তিনি হার্ট ফেইলিওরে চলে গেছেন। বুকে ঘরঘর করছে। শ্বাস নিতে পারছেন না। শুনলাম কাল রাতে একবার নেবুলাইসার ব্যবহার করেছেন কিন্তু উপশম হয় নি। প্রেসার চেক করে দেখলাম ওপরের প্রেসার ২০০ ছাড়িয়ে গেছে। নিচেরটা ১০০-এর ওপরে। গত তিন-চার দিন তার প্রেসারের ওষুধ বন্ধ আছে। আমি একটা এক্স-রে করিয়ে আনতে বললাম। এক্স-রেতে দেখলাম খুব বেশি পালমোনারি ইডিমা হয়ে গেছে, মানে ফুসফুসে জল জমে গেছে। বুঝলাম একদিকে হাই প্রেসার অন্যদিকে অতিরিক্ত স্যালাইন চালাবার জন্য এবং বাড়িতে বেশি করে ওআরএস খাবার জন্য শরীরে জল বেড়ে গিয়ে এই সাঙ্ঘাতিক অবস্থা হয়েছে। হয়ত ওনার আগে অল্পস্বল্প হার্ট ফেইলিওর ছিল। ধরা পড়ে নি। এই সময়ে সেটা বেড়ে গেছে।
আমি তাড়াতাড়ি হাসপাতালে ভর্তি করতে বললাম। ওনারা সম্পন্ন পরিবার। মেডিক্লেম আছে। তবু বারবার আমাকে বললেন, বাড়িতে অক্সিজেন দিয়ে চেষ্টা করে দেখতে। আমি অনেক বোঝানোয় তারা হাসপাতালে নিয়ে গেল। ওনাকে দেখি সকাল দশটায়। দুপুরে সাড়ে তিনটের সময় তার স্ত্রী ফোন করে কাঁদতে কাঁদতে বলল, উনি মারা গেছেন। আমি কি ওনার ডেথ সার্টিফিকেট দিতে পারব? ওনার অবস্থা খুবই খারাপ ছিল কিন্তু পাঁচ ঘন্টার মধ্যে মারা যাবেন আমি সেটা ভাবতেও পারি নি।
বিকেলে ডেথ সার্টিফিকেট নিতে এলে তাদের মুখে শুনলাম তারা প্রথমে ব্যারাকপুরের এক নার্সিং হোমে ভর্তির চেষ্টা করে। সেখানে ওরা শ্বাসকষ্ট দেখে ভর্তি না নিয়ে আধঘন্টা ধরে এমার্জেন্সিতে ইঞ্জেকশন দিয়ে প্রেসার কমানোর চেষ্টা করে। কিন্তু রুগির অবস্থা খারাপ হওয়ায় তারা ‘বেড নেই’ বলে তাকে ছেড়ে দেয়। তারা তখন কলকাতার এক নামি নার্সিং হোমে নিয়ে যান। সেখানেও তারা ইমার্জেন্সিতে বেশ কিছুক্ষণ চেষ্টা করে আই সি সি ইউ-তে বেড নেই বলে ছেড়ে দেয়। তারা তখন একজনের সাথে যোগাযোগ করে বেলঘরিয়ার কাছে এক নার্সিং হোমে বেড বুক করে তাকে ফিরিয়ে নিয়ে আসে। মেডিক্লেমের কাগজপত্র চেক করতে করতেই উনি সাড়ে তিনটের দিকে মারা যান।
পেশেন্টের ঠিক কি হয়েছিল, নার্সিং হোমে কি চিকিৎসা হয়েছিল তা আমার পক্ষে বলা সম্ভব নয়। কিন্তু যেটা বুঝতে পেরেছি সেটা অনেক নার্সিং হোমই শ্বাসকষ্টের পেশেন্টদের এখন কোভিড সন্দেহে ভর্তি নিতে চাইছেন না। ওনার কোভিড হয়েছিল কিনা আমি জানি না। খুব সম্ভবত হয় নি। চেস্ট এক্স-রে সাদা হয়ে গিয়েছিল সম্ভবত পালমোনারি ইডিমাতেই। কিন্তু সঙ্গে সঙ্গে এটাও সত্যি কোভিডের ভয়ে অনেক নার্সিং হোমই বেড নেই বলে ইমার্জেন্সি রুগিদের ফিরিয়ে দিচ্ছে। সময়মত চিকিৎসা শুরু হলে উনি বেঁচেও যেতে পারতেন। নিদেন পক্ষে হয়ত এই কয়েক ঘন্টায় মারা যেতেন না।
তাই এখন যা পরিস্থিতি তাতে আপৎকালীন অবস্থায় রুগিদের হাসপাতালে ভর্তি হওয়া খুব কঠিন। সারা কলকাতায় প্রায় সব আই সি সি ইউ ভর্তি। যদিও কিছু ফাঁকা হয় তারা কোভিডের সিম্পটম থাকলে রুগি ভর্তি নিতে চাইছে না। পেশেন্টরাও কোভিড হাসপাতালে সঙ্গত কারণেই ভর্তি হতে চাইছে না। তাই পরিস্থিতি আরও জটিল হচ্ছে। রাতারাতি এই অবস্থা যে পালটে যাবে তার কোনো আশা নেই। তাই আমি আমার রুগিদের সবসময় বলছি এই অসময়ে কষ্ট করে হলেও নিজেদের ওষুধ চালু রাখতে। হাসপাতালে যাবার দরকার হলে যেতেই হবে। বাড়িতে হাসপাতাল সৃষ্টি করতে গেলে আমার ওপরের রুগিটির হাল হতে পারে। আর হাসপাতালে যাওয়া এড়াতে হলে খুব সাবধানে থাকতে হবে আর নিয়মিত ওষুধ খেতে হবে। একবার প্রেসার সামান্য কম হলেই প্রেসারের ওষুধ বন্ধ করে দিলে খুব সমস্যা সৃষ্টি হতে পারে। নিজেদের সাবধানতা অবলম্বন করা ছাড়া আমাদের হাতে বিশেষ কিছু উপায় নেই।
আর আমরা ডাক্তারবাবুরাও বিগত দু-মাস ধরে হোয়াটস অ্যাপ, মেসেঞ্জারে রুগিদের নানা অ্যাডভাইস দিতে বাধ্য থেকেছি। কিন্তু পেশেন্টদের সম্পর্কে বিশেষ কিছু না জেনে এই চিকিৎসার অনেক অসুবিধে আছে।
আমরা ডাক্তাররা এত মৃত্যু দেখি যে মৃত্যু আমাদের খুব প্রভাবিত করে না। কিন্তু কিছু কিছু মৃত্যু করে। ওই ভদ্রলোক আমার চেম্বারে বসে হাঁপাতে হাঁপাতে আমাকে জিজ্ঞাসা করেছিলেন আমি মন্মথনাথ স্কুলে পড়তাম কিনা? উনি আর আমি একই স্কুলের জেনে উনি খুশি হয়েছিলেন। আমার মত উনিও তখন জানতেন না আর পাঁচ ঘণ্টার মধ্যেই উনি তার পরিবার রেখে চিরবিদায় নেবেন। আকস্মিক এরকম মৃত্যুগুলো মনে ছাপ রেখে যায়। কিছু করতে না পারার জন্য নিজেকে অপদার্থ বলে মনে হয়।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *