স্টেথোস্কোপঃ ৫৮

অনেকদিন পরে আবার আমার প্রিয় এই বিভাগে লিখতে বসেছি। চারপাশের পরিস্থিতি খুব খারাপ হয়ে গেছে এই ক’দিনে। আমাদের ব্যারাকপুরের অবস্থা মোটেই সুবিধার নয়। যখন লকডাউন চলছিল তখন পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে ছিল কিন্তু এখন নিয়ন্ত্রণ লাগামছাড়া হতেই বিপর্যয় শুরু হয়ে গেছে। গত সপ্তাহেই শুধু আমার চেম্বারে দেখানো প্রায় জনা পাঁচেক লোকের কোভিড-১৯ ধরা পড়েছে। আরও অনেককে আমি করাতে দিই নি কিন্তু আমি না থাকার সময় অন্য ডাক্তারকে দেখানোয় তারা টেস্ট করাতে দেওয়ায় রিপোর্ট পজিটিভ এসেছে। অনেককে দেখে মনে হয়েছে তাদের কোভিড পজিটিভ হতে পারে কিন্তু তারা টেস্ট করাতে উৎসাহী না হওয়ায় আমার পক্ষে জানা সম্ভব হয় নি। যারা আমাকে দেখাতে এসেছিলেন তারা আমার চেম্বারে আসা অন্য কাউকে সংক্রমিত করে থাকতেই পারেন। আমার পক্ষে সেটা বোঝাও সম্ভব নয়।
এ অবস্থায় চেম্বার বন্ধ রাখাই সবচেয়ে সঠিক সিদ্ধান্ত। কিন্তু চারপাশে এত জ্বর মহামারীর আকারে ছেয়ে গেছে যে আমাকে যারা এত বছর ধরে দেখিয়ে এসেছেন তাদের এই সময় সাহায্য না করাটা আমার মতে সঠিক সিদ্ধান্ত নয়। তাই দু’বেলা চেম্বার খোলা রাখতেই হচ্ছে- অন্তত যে কয়দিন আমি ব্যারাকপুরে থাকছি। আমার পক্ষে পিপিই পরে পেশেন্ট দেখাই উচিত। কিন্তু আমি আগেই বলেছি আমার চেম্বার যেহেতু নন-এসি তাই এই ভ্যাপসা গরমের পরিবেশে একটানা তিন-চার ঘন্টা পিপিই পরে পেশেন্ট দেখলে আমার নিজেকে ডিহাইড্রেশানের জন্য হাসপাতালে ভর্তি হতে হবে। তাই পিপিই বাদে আর অন্য যতভাবে সতর্কতার সঙ্গে রুগি দেখা সম্ভব আমি তাই দেখছি। চেম্বার বেশ কয়েকবার স্যানিটাইজ করেছি। কিন্তু মারণ ভাইরাস এতকিছুর পরেও যে আঘাত হানতে পারে তা আমি জানি।

lockdown


আমার যেহেতু মালদা মেডিকেল কলেজে এখন পোস্টিং তাই প্রতি সপ্তাহে ট্রেনে করে আসা-যাওয়া করছি। এটাও খুব বিপজ্জনক। কিন্তু এছাড়া এইসময় আর কোনো রাস্তা আমার কাছে খোলা নেই। তাই নিজের সম্পর্কে আশঙ্কিত হলেও যেহেতু বেশি ভাবলে আমার কাজ ঠিকভাবে করতে পারব না তাই নিজের নিরাপত্তা কিছুটা লঘু করে না দেখলে আমার পক্ষে এসময় কাজ করা সম্ভব নয়। তবে আমি আশা করব আমার রুগিরা আমার এই শাঁখের করাতের মত অবস্থা অনুধাবন করতে পারছেন। এই একই সমস্যা যে শুধু আমার তাই নয় আমার অন্য সব সহকর্মীরাও একই অবস্থার মধ্যে দিয়েই যাচ্ছেন। আমি তাই আমার পেশেন্টদের বলব আমি এই সমস্যা থেকে আমাকে এবং আপনাদের সুরক্ষিত রাখতে যে কয়েকটি সাধারণ উপায়ের কথা ভেবেছি তা আপনাদের জানাতে চাই।
যারা আমাকে হপ্তাখানেকের মধ্যে দেখিয়ে গেছেন তাদের রিপোর্ট দেখানোর থাকলে তারা আমার প্রেসক্রিপশন ও রিপোর্ট ছবি তুলে হোয়াতে পাঠালে আমি আপনাদের সাথে হোয়াতে যোগাযোগ করে নেব। অযথা রিপোর্ট দেখাবার জন্য চেম্বারে ভিড় করে লাইনে দাঁড়িয়ে নিজেদের বিপদ বাড়াবেন না। রিপোর্ট দেখে যদি মনে হয় আপনার দেখা করা দরকার আমি আপনাদের জানিয়ে দেব।
সারাদিনে আমার কম করে কয়েক’শ ফোন আসে। আপনারাই করেন। অধিকাংশই ফোন করে আমি বসব কিনা বা কখন বসব তা জানার জন্য। আমার চেম্বারের বাইরেই তা লেখা আছে কিংবা আমার মার্চের পর নতুন প্রেস্ক্রিপশনে সময় লেখা আছে। সেটা জেনে নিন। আপনাদের পক্ষে ফোন করাটা সহজ। আমার পক্ষে বারবার ফোন করে একই কথা বলা খুব বিরক্তিকর। মাঝে মাঝে নিজের মেজাজও ধরে রাখতে পারি না। অকারণে আমাকে ফোন করে তাই বিরক্ত করলে আমি ফোন সুইচ অফ করে রাখতে বাধ্য হব। এতে কারোর লাভ হবে না। আর আমি জানি আপনারা সবাই ভীত, সন্ত্রস্ত। নিজেদের ভয় লাঘব করার জন্যও অকারণে আমাকে ফোন করবেন না। বরং হোয়াটস অ্যাপ করুন। আমি সাধ্যমত চেষ্টা করব।
সবাই মাস্ক পরে আসুন। আমার অনেক গরিব রুগি আছেন। তারা ভাল মাস্ক কিনতে পারেন না। কিন্তু যাই হোক আমার চেম্বারে এলে মুখে রুমাল বেঁধে সেই মাস্কটিই পরে আসুন। কিন্তু মাস্ক ছাড়া আসবেন না বা মাস্ক নামিয়ে কথা বলবেন না। আমি কিন্তু তাহলে ফিরিয়ে দিতে বাধ্য হব।
সব রুগিকে ছুঁয়ে দেখার দরকার নেই। তাই সবাই যদি ভাবেন ডাক্তারবাবু আমার বুকে স্টেথো লাগিয়ে দেখলেন না কেন- আপাতত কিছুদিন অন্তত সেই পরিতৃপ্তি আমি আপনাদের দিতে পারছি না। তবে যাদের সেভাবে দেখা দরকার আমি অবশ্যই দেখব। সেটা আমার ওপরেই ছেড়ে দিন। ডিজিট্যাল যন্ত্রতে আমি ব্লাড প্রেসার দেখছি। আমি সবাইকে বলছি যারা শুধু প্রেসার চেক করাতে আমার কাছে আসছেন তারা সেই কাজটি বাড়িতে বসেই করে নিতে পারেন।
যারা আমার ক্রনিক পেশেন্ট তাদের প্রেসার সুগার নর্মাল থাকলে রুটিন চেক-আপ করার জন্য আগামি দু’মাস আপনাদের আমার কাছে না এলেও চলবে। সমস্যা হলে অবশ্যই আসবেন। আরেকটা কথা আগেও বলেছি আবার বলছি। এই সময় কেউ নিজের ওষুধ বন্ধ করবেন না। অনেকেই লক-ডাউনে এটা করে খুব সমস্যায় পড়েছেন। তাই কোনো ওষুধ ডাক্তারের পরামর্শ ছাড়া বন্ধ করবেন না।
আমি সকালে ১৫ জন সন্ধ্যায় ১৫ জনের বেশি রুগি দেখছি না। অযথা আমাকে বেশি রুগি দেখার জন্য জোর করবেন না। এটা আমার আপনাদের সকলের ভালোর জন্যই। চেম্বারে বেশি ভিড় হওয়াটা এখন কোনোভাবেই ঠিক নয়। আপনারা তাই রেগে না গিয়ে আমার সাথে সহযোগিতা করবেন এটাই আশা রাখি।
জ্বরের ব্যাপারে যেটা বলি অনেকেই এসে আমাকে জিজ্ঞাসা করেন ডাক্তারবাবু আমার করোনা হয় নি তো? সত্যিই পরীক্ষা না করে আমার পক্ষে এটা বলা একেবারেই সম্ভব নয়। তাই জ্বর এলে আমি সবাইকেই প্রায় করোনা টেস্টের জন্য লিখে দিচ্ছি। যারা বাইরের থেকে করাতে পারবেন না তারা বি এন বোস হাসপাতালের ফিভার ক্লিনিকে দেখিয়ে টেস্ট করে নিন। আগে সবাইকে টেস্ট করাতে বলছিলাম না। কিন্তু এখন এমন এমন করোনায় আক্রান্ত পাচ্ছি যাদের করোনা হতে পারে আমিও ভাবি নি। আমার অনেক পেশেন্ট সরকারি নিয়ম মেনে হোম কোয়ারেনন্টাইনে আছেন। তাদের বাড়ির লোকেরাই সাবধানে তাদের পরিচর্যা করছেন। যাদের বাড়িতে অত জায়গা নেই তাদের সরকারি হাসপাতালে ভর্তি হওয়া ছাড়া কোনো উপায় নেই। নিজেদের কষ্ট হলেও যাদের জ্বর-কাশি-পেট খারাপ কমছে না তারা করোনার টেস্ট করিয়ে নিন। অনেকেই বলছেন সরকারি জায়গায় গেলেই টেস্ট হচ্ছে না। সেটা স্বাভাবিক। করোনা টেস্ট এত খরচসাপেক্ষ যে সরকারের পক্ষেও আমাদের দেশে সব রেফারেল রুগির টেস্ট করা সম্ভব না। তাই যারা পারছেন তারা বাইরে থেকেই টেস্ট করান। যারা ডায়াবিটিস, প্রেসার, কিডনির অসুখ বা ক্যান্সারে ভুগছেন তাদের জ্বর হলে টেস্ট করে নেওয়াই ভাল। কারন গত ক’দিনে এমন অনেক পেশেন্টের পজিটিভ পেয়েছি আমাদের এলাকায়।
এখন বাইরে বেরোলে বোঝার উপায় নেই যে আনলক চলছে। সবাই আগের মত সর্বত্র ভিড় করা শুরু করে দিয়েছেন। এ নিয়ে আমার নতুন করে বলার কিছু নেই। সব মিডিয়ায় এ নিয়ে প্রচুর প্রচার চলছে। আমি শুধু যেটুকু বলতে পারি আমার চেম্বারে যাতে আপনাদের বেশি ভিড় না হয় সেটা দেখার দায়িত্ব আমার। তাই একজন রুগির সাথে টোটো বা অটো বোঝাই করে তিন-চার জন দেখাতে আসবেন না। আসলেও চেম্বারে রুগির সাথে একজনই ঢুকুন। আর যিনি সক্ষম তিনি একাই আসুন। স্যানিটাইজার সঙ্গে নিয়ে আসুন। জামা-কাপড় চেম্বার থেকে ফিরে ছেড়ে ফেলুন।
কলকাতার ডাক্তারবাবুরা অনেকে ওয়েব কন্সাল্টেশন করছেন। আমার যে রুগির প্রোফাইল তাতে এটা এখনও দিবাস্বপ্ন। তবে মনে হয় আগামি বছরখানেকের মধ্যে এটা এখানেও চালু হয়ে যাবে। আজকের এই পোস্ট আমি কিন্তু কাউকে ভয় দেখানোর জন্য লিখছি না। তবে আমার পেশেন্টদের অনেকের মনেই লক ডাউন আংশিক উঠে যাবার পর একটা মিথ্যে নিরাপত্তাবোধ তৈরি হয়েছে যেটা আমার মনে হচ্ছে বিপজ্জনক। ডাক্তারবাবুর চেম্বার হাসপাতালের থেকে কিছু কম বিপজ্জনক নয়। তাই যার না এলেই নয় তিনিই দেখাতে আসুন।
অযথা ভয় পাওয়ার যেমন কারণ নেই তেমনি গা-ছাড়া মনোভাবও বিপদ ডেকে আনতে পারে। আপনাদের কাছে তাই আমার যা বলার তা হল আপনারা আমাকে সাহায্য করবেন এবং আমার সীমাবদ্ধতা উপলব্ধি করবেন এটা আশা রাখি। আমি যেটুকু পরিষেবা এখন দিচ্ছি এর থেকে বেশি দেওয়া আমার পক্ষে এখন সম্ভব নয়। পরিস্থিতি খারাপ হলে এটুকুও দিতে পারব কিনা জানি না। আরেকটা কথা আমি বছরখানেকের ওপরে নিজের বাড়িতে চেম্বার বন্ধ রেখেছি। নিজের চেম্বারেই বসি। তাই কেউ আমার বাড়িতে এসে আমাকে রুগি দেখে দেওয়ার অনুরোধ করবেন না। আমার বাড়ির লোকেরা এমনিতেই আমার জন্য সংক্রমণের বিপদের মধ্যে থাকেন তাদের অতিরিক্ত বিপদে ফেলার কোনো অধিকার আমার নেই।

সবাই ভালো থাকুন। আপনার মত আমারও মনে হয় এই সময় হয়ত আর বেশিদিন স্থায়ী হবে না।

One thought on “স্টেথোস্কোপঃ ৫৮

  • August 1, 2020 at 7:30 pm
    Permalink

    সময়োপযোগী এবং বাস্তব সম্মত হয়েছে।

    Reply

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *